রাজনীতি

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোটার আনার ছক বনাম সংঘাতের ভয়

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ৪:৩৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৫, ২০২৪

৭ জানুয়ারির নির্বাচনে যেমন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি নেই, তেমনি নেই আরো কিছু উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল। বিএনপিসহ অন্য দলগুলো এই নির্বাচনকে একতরফা বলে অভিযোগ তুলেছে। ফলে এই নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাঠে নামিয়ে নির্বাচন জমজমাট করার চেষ্টা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এর বাইরে জাতীয় পার্টি ছাড়াও নির্বাচনে আছে বেশ কিছু ছোট দল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই নির্বাচন কতটা জমে উঠলো সেটা একটা বড় প্রশ্ন। ভোটারদের অংশগ্রহণ কেমন হবে সেটাও দেখার বিষয়।

ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। নির্বাচনী আসন হিসেবে এর নাম নারায়ণগঞ্জ-১। সেখানেই ভক্তবলী নামের এক গ্রামে বেশ বড় একটি একটি নির্বাচনি সভা দেখা গেলো। সভাটি কেটলি মার্কায় স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভুইয়ার। মি. ভুইয়া আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা। তার প্রচারণাগুলোতে বেশ লোকসাগম হচ্ছে। ভক্তবলী থেকে এগিয়ে ইছাখালী ব্রিজের গোড়ায় গিয়ে দেখা গেলো কয়েক হাজার নারী-পুরুষের খণ্ড খণ্ড মিছিল। কোন কোন মিছিলে আছে ব্যান্ড পার্টির বাদ্য-বাজনা। পুরো এলাকা মুখর নৌকার শ্লোগানে। নৌকা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী যখন পাড়া-মহল্লা মাতিয়ে রেখেছেন তখন বসে নেই এই আসনের আরেক আলোচিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার। একইভাবে পাড়া-মহল্লায় জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন নৌকার প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজী। প্রতিদিনই হাজির হচ্ছেন বড় বড় মিছিল নিয়ে। কিংস পার্টি হিসেবে পরিচিত আলোচিত দল তৃণমূল বিএনপি’র শীর্ষ নেতা হওয়ায় তৈমুর আলমকে নিয়েও ভোটারদের আগ্রহ আছে। তৈমুর আলম প্রতিদিনই নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে এসে গাড়িবহর নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় প্রচারণা চালাচ্ছেন। সবমিলিয়ে নারায়ণগঞ্জ -১ আসনের সবখানেই ভোটের আমেজ স্পষ্ট। আব্দুল খালেক নামে একজন ভোটার বললেন, এই আসনে অন্তত চারজন প্রার্থী শক্তিশালী। তারা সবাই মাঠে থাকায় ‘হাড্ডাহাড্ডি লড়াই’ হবে।

ভোটার আনতে বড় বাধা ‘সহিংসতার ভয়’
বিএনপি বিহীন এবারের নির্বাচনকে জমজমাট এবং নির্বাচনে ভোটার টানার জন্য আওয়ামী লীগের যে কৌশল তার বড় অংশ জুড়েই আছে স্বতন্ত্র এবং অন্য ছোটদলগুলোর প্রার্থীদের মাঠে নামানো। রূপগঞ্জে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়াও তৈমুর আলম খন্দকারের ব্যক্তিগত পরিচিতির কারণে ভালো অবস্থায় আছে তৃণমূল বিএনপি। আছে লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুল ইসলাম। শক্তিশালী এই চার প্রার্থী ভোটারদের নিবাচনে উৎসাহী করে তুলতে পারলেও শেষ পর্যন্ত ভোটারদের কেন্দ্রে আনা যাবে কি-না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে নৌকার প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর। যার মূল কারণ তাদের ভাষায় নৌকার প্রার্থীর পক্ষ থেকে ভয়-ভীতি দেখানো।

আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভুইয়া বলেন, নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহ আছে, উৎসবও আছে। তবে তারা শেষ পর্যন্ত ভোট দিতে আসবে কি-না তা নিয়ে সন্দিহান তিনি। নৌকার প্রার্থীর লোকজন, তারা কিছু আতংক ছড়াচ্ছে। বলছে কেটলি মার্কায় ভোট দিলে বিদ্যুৎ-গ্যাস-পানির লাইন কেটে দেয়া হবে। এবং বিভিন্ন ভাতা আছে সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে।

তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকারও অভিযোগ করছেন যে, নৌকার প্রার্থীর সমর্থকরা নৌকার বাইরে অন্য মার্কায় ভোট না দিতে ভয়-ভীতি দেখাচ্ছেন ভোটারদের। এতে হয়তো ভোটাররা ভোট দিতেই যাবেন না। এখানে নৌকার প্রার্থীর যে দাপট, তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছে যেন আমরা এজেন্ট না পাই। হুমকি দেয়া হচ্ছে যে ৭ই জানুয়ারির পর দেখে নেয়া হবে। এমন হলে তো ভোটাররা ভয়ের মধ্যে থাকবে।

তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী গোলাম দস্তগীর গাজী এসব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, কোনরকম ভয়-ভীতি দেখানোর সঙ্গে তারা নেই। ভোট হবে উৎসবমুখর পরিবেশে। এখানে কোন আতংকের পরিস্থিতি নাই। যেহেতু বিএনপি মাঠে নেই, আতংকও নেই। আমি কাউকে ভয় দেখাতে বলি না। এটা কোনকালেই এখানে হয়না। এখানে নির্বাচন কমিশন খুব শক্তহাতে এগুলো দেখছে।

নারায়ণগঞ্জ ১ আসনে এই তিন প্রার্থী ছাড়াও আরো আছেন চেয়ার প্রতীকে ইসলামিক ফ্রন্টের একেএম শহীদুল ইসলাম, ট্রাক প্রতীকে মো. জয়নাল আবেদীন চৌধুরী, ঈগল প্রতীকে গাজী গোলাম মুর্তুজা, আলমিরা প্রতীকে মো. হাবিবুর রহমান এবং জাকের পার্টির মো. জোবায়ের আলম ভুইয়া। সবমিলিয়ে পাল্টা-পাল্টি অভিযোগ থাকলেও এটা স্পষ্ট যে, নারায়ণগঞ্জ ১ আসনে ভোটের লড়াই জমে উঠেছে। কিন্তু সবখানে পরিস্থিতি এমন নয়।

নরসিংদী-২ আসনে উল্টোচিত্র
নারায়ণগঞ্জ ১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ভোটের আমেজ থাকলেও সব আসনে সেটা নেই। যেমন নরসিংদী-২ আসন। সেখানকার আসনের অধিকাংশ রাস্তাঘাটে ব্যানার-ফেস্টুন তেমন নেই। যেখানে আছে, সেটাও মূলত: নৌকা প্রতীকের। যদিও প্রার্থী আছেন ৪ জন। শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নৌকার প্রচারও চলছে ঢিমেতালে। ফলে এই এলাকায় ভোটের আমেজ নেই, প্রতিদ্বন্দ্বিতাও নেই। প্রচারণাও সীমিত। বিষয়টি স্বীকার করছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আনোয়ারুল আশরাফ খানও। “এখানে প্রতিদ্বন্দ্বী নাই এভাবে বলা ঠিক হবে না। সেটা আছে। কিন্তু তারা শক্তভাবে অংশগ্রহণ করছে না। আমি তাদেরকে বলেছি, তোমাদের নির্বাচনি কাজে যদি কোন সাহায্য লাগে তাহলে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করো। আমাদের কর্মী আছে, তারা তোমাদেরকে সাহায্য করবে। কিন্তু তারা কেন যেন ভয়ে নাকি কী কারণে সেভাবে মাঠে আসে না।”

নরসিংদী ২ আসনে অন্য প্রার্থীরা হচ্ছেন ঈগল প্রতীকে মো. মাসুম বিল্লাহ, জাতীয় পার্টির এ এনএম রফিকুল আলম সেলিম এবং দোলনা প্রতীকে আফরোজা সুলতানা। এসব প্রার্থী সেভাবে মাঠে না থাকায় একদিকে যেমন নির্বাচন জমে ওঠেনি অন্যদিকে একতরফা ভোটে অনেক ভোটারের মধ্যেও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। যদিও স্থানীয় আওয়ামী লীগের আশা ভোট পড়বে ৬০ শতাংশের উপরে। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব?

‘টার্গেট’ নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভাতাভোগী ভোটার
স্থানীয় আওয়ামী লীগ যে ষাট শতাংশের উপরে ভোট কাস্টিং হবে বলে ধারণা দিচ্ছে তার পেছনে অনেক কারণ আছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে, নির্বাচনের দিন যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হবে ইত্যাদি। কিন্তু ভোটার উপস্থিতির পেছনে তাদের সবচেয়ে বড় আশার জায়গা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় যেসব ভোটার রয়েছেন, ভোটকেন্দ্রে তাদের উপস্থিতি।

নরসিংদীর পলাশ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম গাজী বলছেন, যারা সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আছে, তারা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা ভোট দিলে একইসঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে গেলে ষাট শতাংশের বেশি ভোট হয়ে যাবে বলে তাদের ধারণা। এখানে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা এমন অনেক সুবিধাভোগী আছে। আমার নিজের ইউনিয়নে প্রায় ছয় হাজার পরিবার এই সুবিধার আওতায় আছে। প্রতি পরিবারে যদি তিনজন সদস্যও ধরি, তাহলে হয় ১৮ হাজার ভোটার। আমার ইউনিয়নে মোট ভোটারই তো ২৮ হাজার। সুতরাং ভোটারের অভাব হবে না।

কিন্তু এসব ভোটার যদি ভোট কেন্দ্রে না যায়? এমন প্রশ্নে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলছেন, সরকারের সুবিধাভোগী হওয়ায় ভোটাররা নিজেরাই ‘ভোট দিতে আগ্রহী’। তবে কার্ডধারীদের কোন ভয়-ভীতি বা চাপ দেয়া হচ্ছে না বলে দাবি করছেন তিনি। যদিও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় যারা সরকারের বিভিন্ন ভাতার আওতায় আছেন, নৌকার জন্য ভোট না দিলে তাদের ভাতা বন্ধের হুমকি এমনকি ভোট নিশ্চিত করার জন্য কার্ড জব্দ করার ঘটনাও প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। এসব নিয়ে বক্তব্য এসেছে নির্বাচন বর্জনকারী বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকেও। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি তাহলে সরকারি ভাতার আওতায় থাকা ব্যক্তিদের ভাতা বাতিলের ভয় দেখিয়ে ভোটকেন্দ্রে আনার পরিকল্পনা করছে?

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দীন নাসিম বলেন, এরকম ঘটনার সত্যতা নেই। সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে যারা আছেন, সেটা কি কোন নেতার বাতিল করার সুযোগ আছে? এটা সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত হয়। স্থানীয়ভাবে এটা বাদ দেয়ার ক্ষমতা নেই। আর দলীয় নোত-কর্মীর তো এর কোন সুযোগই নেই। এগুলো নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যারা ভোট বানচাল করতে চায় তাদের কৌশল। ভয়ভীতি নয় বরং ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে পারায় তারা এমনিতেই ভোটকেন্দ্রে আসবেন। যদিও রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন মনে করেন বিভিন্ন বাস্তবতায় সেটা সহজ হবে না। আমরা যে মিছিল বা ক্যাম্পেইন দেখছি, সেটা কিন্তু দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। যদি জনগণ এখানে অংশগ্রহণ করতো তাহলে সেটার চরিত্র, দৃশ্য অন্যরকম হতো। এখন যে ভোটে সমঝোতা আগেই হয়ে গেছে, কে নির্বাচিত হবে সেটা জানা, সেখানে অনেকে মনে করতে পারে ভোট দেয়া বা না দেয়া কোন অর্থ বহন করে না। এছাড়া গত দুটি নির্বাচনে যারা ভোট দিতে পারেন নাই, তাদেরও অনাগ্রহ থাকতে পারে। সুতরাং ভোটার কেন্দ্রে না যাওয়ার অনেক কারণ আছে। এর পাশাপাশি যদি কোথাও সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি হয়, তাহলে ভোটাররা আতংকিত হয়ে ভোট না দিতে পারে।

বাংলাদেশে নির্বাচনের দিন এবং এর আগের দিন পরিস্থিতি কতটা শান্তিপূর্ন থাকে, ভোট পড়ার ক্ষেত্রে সেটা একটা বড় নিয়ামক হয়ে ওঠে। কিন্তু নির্বাচনে প্রচারণা শুরুর পর বেশ কয়েকটি জেলায় যেভাবে সহিংসতা হয়েছে, তাতে করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে অনেক ভোটারের মধ্যেই। অন্যদিকে সরকারি দলের বিপরীতে কার্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় ভোটারদের মধ্যেও সেভাবে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। অনেক আসনে সেভাবে নির্বাচনের আমেজও নেই। ফলে শেষ পর্যন্ত ভোটাররা ভোট দিতে কতটা আগ্রহী হবেন সেটা এখনো একটা বড় প্রশ্ন।


সূত্র : বিবিসি বাংলা