রাজনীতি

এরশাদকে ছাড়া প্রথম নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অবস্থান কি আরো নড়বড়ে?

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ৫:১১ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৯, ২০২৩

বিগত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে করার পর এবার সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ‘সরকারি দল আওয়ামী লীগের পরামর্শেই’ আলাদা করে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বুধবার রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে জাতীয় পার্টির নেতাদের এক গোপন বৈঠকে নির্বাচনী কৌশল নিয়ে আলোচনার পর এমন সিদ্ধান্তের কথাই জানিয়েছে দলটি।

তবে প্রকাশ্যে নেতারা যাই বলুন, ত্রিশটিরও বেশি আসনে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা যাতে জয়লাভ করতে পারে সেজন্য সরকারি দলের সাথে এক ধরণের ‘গোপন সমঝোতা’র আভাস দিয়েছেন দলটির নেতারা। তারা বলছেন, আলাদা নির্বাচন করলেও দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতা যাতে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারেন সেজন্য সরকারি দল আওয়ামী লীগের ‘সহযোগিতা প্রত্যাশা’ করেছেন তারা।

দলের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুল হক চুন্নু অবশ্য বলেছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে এবং ভোটাররা ভোট দিতে পারলে আওয়ামী লীগ-বিরোধী ভোট পেয়ে জাতীয় পার্টি আগের চেয়েও এবার নির্বাচনে ভালো ফল করবে বলেই বিশ্বাস তাদের। আসন বণ্টন নিয়ে কোন আলোচনা তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে করেননি। নির্বাচন সঠিকভাবে করতে আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনকে কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে তা নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আওয়ামী লীগ কথা দিয়েছে নির্বাচন কমিশনকে যা যা সাহায্য দিতে হয়, তারা সেটি দেবে। আমরা মনে করি নির্বাচন যদি ভালো পরিস্থিতিতে হয় তাহলে জাতীয় পার্টি ভালো করবে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন, জাতীয় পার্টির নেতারা যাই বলুন গত কয়েকদিনে তাদের কথায় আওয়ামী লীগের প্রতি ‘এক ধরণের অনুনয় বিনয়’ প্রকাশ পেয়েছে। কারণ তারাও জানেন আওয়ামী লীগের সহযোগিতা ছাড়া তাদের প্রার্থীদের জয় পাওয়া কঠিন হবে।

এরশাদ ছাড়া প্রথম নির্বাচন, পার্থক্য কতটা
১৯৯০ সালে প্রবল গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছাড়ার মাত্র দু মাসের মধ্যে জেলে থেকে পাঁচটি আসনে জিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দারুণ ভাবে ফিরে এসেছিলো জাতীয় পার্টি ও এর প্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এরপর বিভিন্ন সময়ে দলটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা অন্য দলে যোগ দিয়ে কিংবা দল ভেঙ্গে বেরিয়ে গেলেও ২০১৯ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নির্বাচনী রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির গুরুত্ব ধরে রাখতে পেরেছিলেন তিনি। ২০০৬ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকারের মেয়াদের শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে কেন্দ্র করে তুমুল আন্দোলনে সময় আওয়ামী লীগের সঙ্গে আরও কয়েকটি দলের সঙ্গে এক মঞ্চে এসেছিলো এরশাদের জাতীয় পার্টি, যার নাম হয় মহাজোট। এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচন বিএনপি ও জামায়াত জোট বর্জন করলে বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছিলো এরশাদ নির্বাচনে অংশ নেবেন কি-না। তার ও জাতীয় পার্টির নির্বাচনে থাকা ও না-থাকা নিয়ে অনেক নাটকীয়তার পরেও দলটি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে এসেছিলো। সেবার ভারতের তদানীন্তন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংহ তখন ঢাকায় এসে এরশাদের সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন। মুজিবুল হক চুন্নু বলছেন, এরশাদ সাহেব ব্যক্তি হিসেবে ফ্যাক্টর ছিলেন। দেশে বিদেশে তার বন্ধু ছিলো। ফলে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করতেন।

বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলছেন জেনারেল এরশাদ ও তার দলের উত্তরবঙ্গ-সহ কিছু এলাকায় নিশ্চিত কিছু আসন ছিলো। এগুলো রাজনীতিতে তার ভ্যালু তৈরি করেছিলো। সে কারণেই আওয়ামী লীগ তাকে ছাড়তে চায়নি। এজন্যই তাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি দল আওয়ামী লীগকে বিভিন্ন সময়ে নানা কৌশল করতে হয়েছে। তবে এবার এরশাদের অনুপস্থিতিতে দলটির সেই অবস্থা আর নেই। এখন জাতীয় পার্টির নেতারা জানেন আওয়ামী লীগের সহায়তা ছাড়া জেতা কঠিন হবে। আবার এরশাদের মতো ব্যক্তি না থাকায় জাতীয় পার্টির নেতারা নিজেদের সব বিবাদ-কলহে প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হচ্ছেন। সব মিলিয়ে বলা যায় এরশাদের অনুপস্থিতিতে দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম পর্বে জাতীয় পার্টি প্রবেশ করেছে।

প্রসঙ্গত, জাতীয় পার্টির দুই শীর্ষ নেতা রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যকার বিরোধ নিরসন-সহ দলটির অভ্যন্তরীণ নানা সংকটের সময়ে দলের নেতাদের গত কয়েক বছরে অনেকবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বারস্থ হতে দেখা গেছে।

জাতীয় পার্টির নির্বাচনী বাস্তবতা
দলটির নেতারা দাবি করছেন একক ভাবে নির্বাচন করলে অনেক জায়গাতেই তাদের প্রার্থীরা আগের চেয়ে ভালো করবে ভোটারদের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিরোধী মনোভাবের কারণে। অনেক জায়গায় আবার আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রায় কাছাকাছি ভোট থাকায় সে সব সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী ভোট জাতীয় পার্টি পাবে বলেও আশা তাদের। তবে বাস্তবতা হলো, গত তিনটি নির্বাচনেই দলটিকে ব্যাপকভাবে আওয়ামী লীগের ওপরই নির্ভর করতে হয়েছে।

মহাজোটের অংশ হিসেবে ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে ৪৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলো জাতীয় পার্টি। এর মধ্যে ২৯টি আসনেই আওয়ামী লীগ তখন কোনও প্রার্থী দেয়নি। বাকী যেই বিশটি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলো তার কোনওটিতেই জিততে পারেনি জাতীয় পার্টি।২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি ৩৩টি আসনে জিতেছিলো এবং এসব আসনে আওয়ামী লীগ কোন প্রার্থী দেয়নি তখন। তখন সারা দেশে ৪৬টি আসনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী থাকলেও এর মধ্যে মাত্র একটিতে জাতীয় পার্টির প্রার্থী জয়লাভ করতে পেরেছিলো।২০১৮ সালের নির্বাচন জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছিলো আওয়ামী লীগ কিন্তু দলটি এর মধ্যে একুশটি আসনে জয়লাভ করেছিলো। দুই দল নির্বাচন করেছিলো এমন ১৪৫টি আসনে তখন জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের জামানতই বাজেয়াপ্ত হয়েছিলো। এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৯৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে শেষ পর্যন্ত ১৪ দলীয় জোটের কয়েকজনকে কিছু আসন ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। অন্যদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছে ২৮৭টি আসনে। কিন্তু গত তিন নির্বাচনের মিত্র জাতীয় পার্টিকে এবার আর সরাসরি আসন ছাড়তে চাইছে না আওয়ামী লীগ, নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করার জন্য।

সিনিয়র নেতাদের নিয়ে উদ্বেগ
এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী দল বিএনপির বর্জন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা কতটা সফল হবেন তা নিয়ে দলের ভেতরেও উদ্বেগ আছে। এ কারণেই দলের সিনিয়র নেতাদের নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে সরকারি দলের সহযোগিতা আশা করেছে দলটির নেতারা, এমন খবরও পাওয়া যাচ্ছে দলেরই নেতাদের কাছ থেকে।

যদিও মুজিবুল হক চুন্নু বলছেন, নির্বাচন নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন নন, বরং তাদের উদ্বেগ নির্বাচন সুষ্ঠু হয় কি-না তা নিয়ে। গত কয়েক বছরে কিছু উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন আমরা দেখেছি। এজন্যই আমাদের উদ্বেগ। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে, ভোটাররা ভোট দিতে পারলে ভোটের নীরব বিপ্লব হবে জাতীয় পার্টির পক্ষে।

কিন্তু এরশাদের অনুপস্থিতিতে দলের নেতৃত্বে দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়ায় দলটির সব কৌশল আওয়ামী লীগের পরামর্শেই নিতে হচ্ছে কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এরশাদ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন এটি সঠিক। কিন্তু বর্তমান চেয়ারম্যান জি এম কাদের তারই ভাই। তিনি রাজনীতিতে খুবই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের একজন। তার নেতৃত্বে দল এবারেও ভালো করবে ও ভালো ভাবেই এগিয়ে যাবে”।

ওদিকে জাতীয় পার্টির সাথে কেন আসন বণ্টন সমঝোতা এবার হচ্ছে না – এমন এক প্রশ্নের জবাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন, “স্ট্রং ডেমোক্রেসির জন্য স্ট্রং অপজিশন দরকার। অপজিশনেরও ভূমিকা থাকুক আমরা চাই”।