নির্বাচন

প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকা কি নতুন ভোটারদের নির্বাচন বিমুখ করছে?

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ৩:৪৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩

বাংলাদেশে একাধারে দুটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের পর আরেকটি নির্বাচন হতে যাচ্ছে অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়াই। সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটাতে অনেকটা মূখ্য ভূমিকা রাখা তরুণ ভোটাররা এবার ভোট নিয়ে কতটা আগ্রহী এ প্রশ্নে মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নতুন ভোটার হয়েছে প্রায় আশি লক্ষ তরুণ-তরুণী। এদের মধ্যে কতভাগ তরুণ ভোটার সাত জানুয়ারি ভোট দিতে যাবেন সেটি এখন বড় প্রশ্ন। ক্ষমতার পরিবর্তন বা পছন্দের প্রার্থী নির্বাচনে এই ভোটারদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবেই বিবেচিত হয়। বিতর্কিত নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় ভোট এমনকি রাজনীতি নিয়েও অনেক তরুণদের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে বলে জানাচ্ছেন তারা।

জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের একজন শিক্ষার্থী আরিফ সোহেল বলেন যেকোনো নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়াটা জরুরি। এ নির্বাচনে তরুণদের আগ্রহে ভাটা পড়েছে। জনগণ যে আসলে প্রশ্ন করার কেউ সেটা প্রমাণ হয় নির্বাচনের ভেতর দিয়ে। নির্বাচন আসলে বিতর্কিত হয়ে যায়, যখন সেটা সুষ্ঠুভাবে হতে পারে না এবং বিশেষ করে তরুণ সমাজ যখন এখান থেকে আগ্রহটা হারিয়ে ফেলে তখন আসলে এই যে প্রশ্ন করার হকদার যে জনগণ এই অধিকারবোধটাই আসলে সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ২০০৯ সালের পরে চৌদ্দ সালের এবং আঠারো সালের নির্বাচন নিয়েও কিন্তু বিতর্ক আছে। একটা জনগোষ্ঠীর একটা জেনারেশন, একটা পুরো প্রজন্ম আসলে সুষ্ঠু ভোট, একটা প্রশ্নহীন ভোট দেখে নাই।

আরেকজন শিক্ষার্থী আয়েশা আক্তার ইতি বলছেন, তিনি ঢাকার ভোটার এবং এবার ভোট দিতে যাবেন। তবে তার কিছু শঙ্কাও আছে। আমাদের আগ্রহের জায়গাটা আছে। কিন্তু এরমধ্যে একটা অনীহাও আছে যে আদৌ সেটা কতটা ফলপ্রসূ হবে। আদৌ আমরা ভোট দিতে পারবো কিনা।

গত নির্বাচনে পরিবারের সদস্যদের ভোটের বাজে অভিজ্ঞতার কারণে প্রথমবার ভোটার হয়েও ভোট দিতে যাবেন কিনা সেটি নিয়ে দ্বিধান্বিত মালিহা নামলা। মালিহা বলেন, নির্বাচনে ভোট দিব এটা ভেবে যে আমি একটা অবদান রাখছি দেশের গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণে। যদি আমার মনে হয় যে আমি সে অবদানটা রাখতে পারছি না বা আমার এটাতে আসলে কোনো কিছু যায় আসে না তখন আমার আসলে এ আগ্রহের জায়গাটাতো থাকবে না। আমি ভোট দিতে যেয়ে তখন কী করবো?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাজীব বিশ্বাস মনে করেন, এবার তরুণ ভোটারদের আগ্রহ আগের তুলনায় বেশি। যেহেতু ইউনিভার্সিটির রানিং স্টুডেন্ট বেশিরভাগই নতুন ভোটার, তাদের মধ্যে ভোট দেয়ার বা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহটা বেশি এবছর।

সুষ্ঠু ভোটের প্রত্যাশা
ঢাকার বাইরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ত্রিশের কোঠায় বয়সী একজন ব্যবসায়ী জানান, ভোটার হওয়ার পর এখনো ভোট দিতে পারেননি। এবার ভোট দেবেন কিনা সেটি নিয়েও অনিশ্চয়তা। তবে তার সঙ্গে থাকা সমবয়সী আরেকজন মনে করেন এবার তাদের এলাকায় ভালো ভোট হবে। বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও নতুন ভোটার সুপ্ত ইসলাম ভোট দিতে আগ্রহী। তবে ভোটের পরিবেশ কেমন হবে সেটি নিয়ে ভাবনা রয়েছে তার। ভোট আসছে ভোট দিব। নতুন ভোটার হিসেবে আমরা সুষ্ঠুভাবে একটা সুন্দর নির্বাচন দেখতে চাই।

আরেজন শিক্ষার্থী নিগার তাসনি মম প্রথম ভোটার হিসেবে একটি শান্তিপূর্ণ ভোট দেখতে চান। তিনি বলেন, আমি যখন ভোট দিতে যাবো ওখানে যেন দলীয় রাজত্ব না চলে। আমি যেন নিরাপদভাবে কোনো ভয়টয় ছাড়া ভোটটা দিতে পারি এটাই হচ্ছে আমার সবচে বড় চাওয়া।

বাংলাদেশের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিস (সিপিজে) পরিচালিত একটি জরিপে অংশ নেয়া ৭২ শতাংশ তরুণ ভোট দিতে ইচ্ছুক বলে মত দিয়েছে। কিন্তু সেটি ছিল সবার অংশগ্রহণের নির্বাচনের প্রশ্নে। অন্যদিকে মার্কিন প্রতিষ্ঠান আইআরই একটি জরিপ পরিচালিত করে, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক ছিল তরুণ, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর। আইআরআই পরিচালিত ওই জরিপের ফলাফলে উঠে এসেছে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনে যারা ভোট দিতে আগ্রহী নন, তারা কেন দেবেন না, এ প্রশ্নে ৫৫ শতাংশের উত্তর ছিল অতীতে তাদের ভোট অন্য কেউ দিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ আশঙ্কা এবার তরুণ ভোটারদের অংশগ্রহণ কম হবে। কারণ হিসেবে তিনিও বিগত দুটি নির্বাচনকে সামনে আনেন। আঠারো বছর হলে ভোট দিবে। পর পর দুটি নির্বাচনে তরুণরা ভোট দিতে পারে নাই। এখন ওই ভোটের হিসেবে আমি বলবো যে তৃতীয় প্রজন্মের তরুণরা এবারো তাদের একই অবস্থাই হচ্ছে যে তাদের সামনে কোনো চয়েস নাই। ফলে তরুণরা এভাবে কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। আমি বলবো যে তাদের মধ্যে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ তৈরি হচ্ছে।

রাজনীতিতে আগ্রহ কতটা
ভোটের রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতি বিমুখ করছে বলে অনেকে অভিযোগ করেন। এছাড়া একটানা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের বাইরে অন্য ছাত্রসংগঠন বা আদর্শিক রাজনীতি করার সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে বলেও অনেকে মনে করেন। সবমিলিয়ে রাজনৈতিক সংকটও দেশে সুষ্ঠু ভোট না হওয়া তরুণদের একটি অংশ রাজনীতি বিমুখ হয়েছে বলেও ধারণা করেন কেউ কেউ।

নতুন ভোটার মেহেরাব সিফাত বলেন, বর্তমানে তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশ রাজনৈতিকভাবে উদাসীন। এটা তৈরি হওয়ার কারণ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে আমরা কোনো তরুণ নেতাদেরকে উঠে আসতে দেখি না যে তারা আসলে পরিশ্রম করে আকাঙ্ক্ষা থেকে রাজনৈতিকভাবে ভালো করেছেন এবং সেখান থেকে একটা পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জিসান বলছেন, “আমরা যদি আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখি যে এখানে একটি ছাত্র সংগঠনেরই একাধিপত্য দেখতে পাচ্ছি। এমনকি যখন অন্যান্য সংগঠন যারা মুভ করার চেষ্টা করছে তাদেরকে আমরা দেখছি, বিভিন্নভাবে তাদেরকে দমন করা হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে রাজনীতির অনীহা যেমন আছে আবার একটা অংশের ভিড় দেখা যায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র ও যুব সংগঠনে।

দেশে তরুণদের রাজনীতিতে ইচ্ছা অনিচ্ছার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, একানব্বই থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত তরুণদের যত সংগঠন বিশেষ করে ছাত্র সংগঠন, যুব-সংগঠন দেখি সবই হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের লাঠিয়াল। এভাবেই চলছে। এরমধ্যে সবাইতো আর লাঠিয়াল হতে চায় না। তবে তরুণরা একেবারেই রাজনীতি বিমুখ এটি মানতে চান না। রাজনীতির যে চেহারা তারা দেখছে এটার প্রতি তাদের ঘৃণা। এদেশের তরুণরা রাজনীতি পছন্দ করেন, রাজনীতি চায় না, অংশগ্রহণ করতে চায় না-এটা একটা বাজে কথা। রাজনীতিটা এত পঁচে গেছে যে এই পঁচা শামুকে কেউ পা কাটতে চায় না।

ভয়ের সংস্কৃতি
বাংলাদেশে এখন তরুণ সমাজের মধ্যে একধরনের ভয়ের সংস্কৃতি কাজ করছে বলেই অনেকে উল্লেখ করছেন। স্বাধীনভাবে যে কোনো ইস্যুতে কথা বলা বা মতামত দেয়ার চিন্তা থেকে তরুণরা সরে এসেছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ। সমাজে বিভিন্ন দৃষ্টান্ত দেখে নিজেরাই চুপ হয়ে যাচ্ছেন বলেই মনে করেন শিক্ষার্থী জিসান। তিনি বলেন, কে কী বলবে সেটা ভেবে ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই এখন প্রকাশ্যে মতামত দিতেও সংকোচ বোধ করেন।

এ বিষয়ে আয়েশা আক্তার বলেন, একদিকে আইনের যেমন ভয় তেমনি পরিস্থিতিগুলোর ভয় তরুণ প্রজন্মের মনের মধ্যে এখন গেড়ে বসেছে। তারা আসলে কথা বলতে ইচ্ছা থাকলেও ইচ্ছাটা প্রকাশ করতে পারে না। আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটা বড় ভয়ের জায়গা হচ্ছে কিছু হলে এর প্রভাবটা আমাদের ফ্যামিলির ওপরে পড়বে কিনা। আমাদের সাইবার সিকিউরিটি আইন এটা অনেক কঠিন করে বানানো হয়েছে যে আমি আসলে ফেইসবুকে লিখতে গিয়ে আমি আবার ব্যাকস্পেস দিয়ে মুছে ফেলি। আমাকে দশবার ভাবতে হয়।

সবমিলিয়ে অবস্থাটাকে একটা দমবন্ধ পরিস্থিতি উল্লেখ করে শিক্ষার্থী আরিফ সোহেল বলেন, এটা জাতির ভবিষ্যতের জন্য খুবই ভয়ঙ্কর।


সূত্র : বিবিসি বাংলা