নির্বাচন

কোন পরিস্থিতিতে নির্বাচন বাতিল করতে পারে নির্বাচন কমিশন?

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ৮:৪৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৯, ২০২৩

আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণা শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই বিরোধী দল অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে, সেই সাথে প্রচারণা ঘিরে বেশ কিছু সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। যদিও নির্বাচন নিয়ে এখনই কোন শঙ্কা দেখছে না নির্বাচন কমিশন, কিন্তু ভোটগ্রহণে বিঘ্ন ঘটলে নির্বাচন কমিশনের হাতে কতটা ক্ষমতা থাকবে?

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে ভোটগ্রহণের আগে তা বন্ধের একটা আইন আগের সব নির্বাচনে ছিল। কিন্তু এ বছর ভোটের আগেই সেটিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। কেননা গত বছর একটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকেই নির্বাচন বাতিলে ইসির ক্ষমতার বিষয়টি নির্বাচনী আইন বা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। একজন সংসদ সদস্যের মৃত্যুর পর গাইবান্ধা জেলার একটি আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করে সরকারের কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছিলো ইসি। এর আট মাসের মাথায় আরপিওতে যে সংশোধন আনা হয়েছিলো সেখানেই পুরো আসনের ভোট বাতিলে ইসির ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হয়। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, সংশোধিত আইনের পর ‘হাত পা বাঁধা’ অবস্থায় প্রথম কোন নির্বাচন আয়োজন করতে যাচ্ছে ইসি।

যদিও নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলছেন, পরিস্থিতি খুব খারাপ হলে নির্বাচন বন্ধ করতে পারবে ইসি। তবে ইসি-র সেই ক্ষমতা আদৌ আছে কিনা এনিয়ে সন্দিহান নির্বাচন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।

এ নিয়ে নির্বাচনী আইনে যা বলা আছে
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট বন্ধের বিষয়টি রয়েছে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও’র ৯১ এর ‘ক’ ধারায়। গত বছর অক্টোবরে গাইবান্ধার ওই উপনির্বাচন বন্ধের পর, চলতি বছর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে আইনের এই ধারায় সংশোধন আনা হয়। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুসারে বাংলাদেশে নির্বাচন পরিচালিত হয়।

সংশোধিত আইনে বলা আছে, বলপ্রয়োগ, ভীতি প্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন কারণে নির্বাচন কমিশন যদি ভোট পরিচালনা করতে না পারে, তাহলে ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্রমতে সম্পূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় ‘ভোটগ্রহণের’ যেকোনো পর্যায়ে নির্বাচনী কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে ইসি। সংশোধিত আইনের এই ধারার একটি শব্দ পরিবর্তনই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে। কেননা, এর আগে ‘ভোটগ্রহণের’ জায়গায় শব্দটি ছিল নির্বাচন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, ‘নির্বাচন’ শব্দের জায়গায় ‘ভোটগ্রহণ’ শব্দটি যুক্ত হওয়াটাই আইনের অনেক বড় একটা পরিবর্তন। কেননা নির্বাচন মানে তফসিল থেকে ভোট পর্যন্ত সময়। আর ভোটগ্রহণ মানে শুধু ভোটের দিন। এই পরিবর্তনটিই সংকট তৈরি করেছে। আরপিও সংশোধনের পর এই ধারাতেই আরেকটি উপধারা যুক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘শুধু কয়েকটি কেন্দ্রের গোলযোগ বা জবরদস্তির কারণে পুরো আসনের ভোট বন্ধ করা যাবে না। শুধু যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে সেগুলোই কেবল বন্ধ করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।

 যে জায়গায় ইসির ‘ক্ষমতা’ নিয়ে বিতর্ক
আরপিওর এই ধারায় সংশোধনের আগে এটি নিয়ে তেমন কোন বিতর্ক বা রাজনৈতিক দলের চাহিদাও ছিল না। প্রশ্নটি চাওর হয় গত বছর অক্টোবরে গাইবান্ধা ৫ আসনের উপনির্বাচনের পর থেকে। ঐ নির্বাচনে সিসি ক্যামেরায় অনেক কেন্দ্রে ভোটের অনিয়মের ছবি দেখে পুরো আসনের নির্বাচন বন্ধ করে দেয় কমিশন। তখন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল জানিয়েছিলেন, ভোটে অনিয়ম ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় পুরো আসনের ভোট বন্ধ করেছেন তারা। মূলত ঐ ঘটনার পরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাদের কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে নির্বাচন কমিশন।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলছিলেন, আরপিও সংশোধনের কারণে এখন শুধু নির্বাচনের দিন ভোট চলাকালীন সময়ে তা বন্ধ করতে পারবে ইসি। নির্বাচনের দিনের আগে গোলযোগ পরিস্থিতি হলেও সে সুযোগ আর নাই। যাতে ইসির ক্ষমতা কিছুটা হলেও কমেছে।

এটি নির্বাচন কমিশনই চেয়েছে বলেই মনে করছেন আরেক সাবেক কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, এর ফলে ইসির আগের সেই আগের ক্ষমতা আর নেই। তারা নিজেরা কেন এবং কী কারণে এই সুযোগ হাতছাড়া করলো,।

যে পরিস্থিতিতে ভোট বাতিলের সুযোগ আছে
বাংলাদেশে নির্বাচনে অনিয়ম বা সহিংসতার কারণে একটি পুরো আসনের ভোট বাতিলের তেমন কোন নজির খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোট বাতিল করে থাকে নির্বাচন কমিশন। এই জায়গায় ভোট বন্ধ করার আগে বেশ কিছু কারণকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে নির্বাচন কমিশন। ‘গোলযোগের কারণে পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন নির্বাচন বন্ধ করতে হয়, এবং কমিশন সেটিই করে, জানাচ্ছিলেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম।

আগামী ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংশোধিত আরপিওর অনুযায়ী। সেখানে নির্বাচন কমিশন কোন কোন পরিস্থিতিতে ভোট বাতিল করতে পারবেন? নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ‘ভোটাররা যদি ভোট দিতে না পারে, কেন্দ্রে যাওয়ার পর যদি তাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়, অনেক জাল ভোট হয়, পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলে, কিংবা ব্যালট বাক্স ছিনতাই হলে তাৎক্ষনিক-ভাবে ঐ কেন্দ্রের ভোট বাতিল করতে পারবেন কেন্দ্রের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা’। শুধু প্রিজাইডিং কর্মকর্তা নন, কেন্দ্রের ভোট বাতিলের এই ক্ষমতা রয়েছে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছেও।

পুরো নির্বাচনী এলাকার ভোট বন্ধ নিয়ে যে প্রশ্ন
জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম হলে পুরো একটি আসনের ভোট বাতিল নিয়ে দুই ধরণের ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে সাবেক ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের কাছ থেকে। গাইবান্ধা উপনির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, আরপিও সংশোধনের আগে পর্যন্ত পুরো আসনের ভোট বাতিলের যে সুযোগ ইসির হাতে ছিল, সেটি এখন আর নেই। ফলে এখন চাইলেও কমিশন আর আগের মতো তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারবে না।

যদিও এই প্রশ্নে ভিন্নমত নেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের। একটি উদাহরণ দিয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলছেন, ‘ভোটের দিন একটি আসনের যতগুলো কেন্দ্রে অনিয়ম ধরা পড়বে; নির্বাচন কমিশন ঠিক ততগুলো কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করতে পারবে। সেক্ষেত্রে ১০০টির মধ্যে ৮০টি কেন্দ্রে অনিয়ম বা কারচুপি হলে পুরো আসনের ভোট বন্ধ করা যাবে না। যেটা হয়েছিলো গাইবান্ধার ক্ষেত্রে। সেই সুযোগ এখন আর নেই’।

ফলাফলের পর ভোট বাতিল নিয়ে নতুন আইনে যা বলা আছে
নির্বাচনে নানা অনিয়ম হলেও ভোট শেষে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণার পর সেটি আর পরিবর্তনের সুযোগ এর আগে আইনে ছিল না। গেলো জুলাইয়ে সংশোধিত আরপিওতে ৯১ এর ‘ক’ ধারার সাথে আরেকটি উপধারা যুক্ত করা হয়। যেখানে বলা হয়, রিটার্নিং কর্মকর্তা ভোটের ফল ঘোষণার পর ঐ আসনের কোনও কেন্দ্র বা পুরো আসনে অনিয়মের তথ্য বা অভিযোগ আসলে ঐ আসনের ফলাফলের গেজেট স্থগিত রাখবে। এরপর তদন্ত করে অভিযোগের সত্যতা পেলে ঐসব কেন্দ্র বা পুরো ফলাফল বাতিল করে নতুন করে ভোটগ্রহণ করবে।

আরপিওর এই ধারা সংশোধনের পর গত মাসে লক্ষ্মীপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দুটি আসনের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটের পরদিন ওই দুটি আসনের তিনটি কেন্দ্রের অনিয়মের ছবি প্রকাশ পায় গণমাধ্যমে। পরে আসন দুটির ফলাফল স্থগিত করে তদন্তের নির্দেশ দেয় কমিশন। অনিয়মের প্রমাণ মিললে তিনটি কেন্দ্রের ফলাফলও বাতিল করা হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত ঐ কেন্দ্রগুলোর ভোট বাদেই দুটি আসনেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর অনেক বেশি ব্যবধানে এগিয়ে থাকায় ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করে ইসি। এর আগে আমাদের হাতে এই সুযোগটাও ছিল না। তখন রিটার্নিং কর্মকর্তার রেজাল্টই গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হতো। আইনের এই সংশোধনের ফলে এখন কমিশনের ক্ষমতা অনেক বেড়েছে, বলেন নির্বাচন কমিশনার আলমগীর।

নির্বাচন কমিশন
আগামী সাতই জানুয়ারির ভোট প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনের মাঠে রয়েছে বাংলাদেশের বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। ভোট প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণার পর নতুন করে প্রশ্ন আসছে- এমন পরিস্থিতি ইসি কী করবে? নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর স্পষ্ট করে বলছেন, ‘আমরা যদি দেখি ব্যাপক গণ্ডগোল হচ্ছে, ভোট করতে গেলে হাজার হাজার লোক মারা যাবে অথবা নির্বাচন করা সম্ভব হবে না, তাহলে আমরা শিডিউল বন্ধ করে দিয়ে আবার ভোট করতে পারবো। আইন আমাদের সেই সুযোগ দিয়েছে।

যদিও আরপিও সংশোধনের পর আর এমন কোন সুযোগ দেখছেন না সাবেক নির্বাচন কমিশনাররা। সাবেক কমিশনার হোসেন বলছেন, কোনো কারণে ভোট বাতিল করলেও তখন আদালতের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে।