নির্বাচন

নির্বাচনে আসা ২৭ দলে আ’লীগ এবং জাতীয় পার্টি ছাড়া বাকিরা কারা

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৫, ২০২৩

 নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিসহ মোট ২৭টি রাজনৈতিক দল এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, যাদের অধিকাংশের সাংগঠনিক কার্যক্রম খুব একটা দেখা যায় না। এর মধ্যে তিনটি দল এবারই প্রথম নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে- তৃণমূল বিএনপি, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন বা বিএনএম এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট বা বিএসপি। এর মধ্যে বিএনএম ও বিএসপি এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখেই গঠন করার কারণে বেশ আলোচনায় এসে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। ওদিকে দেশে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিএনপিসহ বেশ কিছু দল নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে এ নির্বাচন বর্জন করছে। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর দাবি বিএনপিসহ ৬২টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করছে।

প্রসঙ্গত, আগামী সাতই জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ দলটির রাজনৈতিক ও কৌশলগত মিত্ররাই প্রধানত এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলছেন, যেসব দল অংশ নিচ্ছে তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি ছাড়া আর কারও বড় পরিসরে ভোট ব্যাংক নেই। তবে এখানে অনেক দল আছে যাদের হয়তো সংগঠন দুর্বল কিংবা ভোট ব্যাংক নেই কিন্তু তারা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এর উদাহরণ হিসেবে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন যাদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে তাদের নাম এ বিষয়ক সার্চ কমিটির কাছে এসেছিলো এনপিপি নামক একটি দলের কাছ থেকে, যা সে সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলছেন, নির্বাচন কেন্দ্র করে যে দলগুলো মাঠে এসেছে তাদের আসলে সারা দেশে দেখা যাবার কোন কারণ ঘটেনি। শীর্ষনেতাদের আসনগুলোতে তাদের কিছু লোকজন দেখা যাচ্ছে। বামপন্থী দলগুলো জনগণের সঙ্গে খুব ভালোভাবেই সম্পৃক্ত। লোকে তাদের ভোট কেন দেয় না তা অন্য আলোচনা। এক্ষেত্রে ভোটারদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির মানের ব্যাপারটা মাথায় রাখা যেতে পারে। আর ধর্মভিত্তিক দলগুলোর নেতাদের, ভক্ত-আশেকান-মুরিদান যত আছে তত সংখ্যক ভোটার আছে বলে মনে হয় না।

কারা অংশ নিচ্ছে
নির্বাচন কমিশনের দেয়া হিসাব অনুযায়ী এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়া দলগুলো হলো- ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, জাকের পার্টি, জাতীয় পার্টি, জাতীয় পার্টি-জেপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, তৃণমূল বিএনপি, ন্যালনাল পিপলস পার্টি(এনপিপি), বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, সুপ্রিম পার্টি, সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, ওয়ার্কার্স পার্টি ও সাম্যবাদী দল।

মাঠে তারা কতটা সক্রিয়
এবার সংসদ নির্বাচনে যারা অংশ নিচ্ছে তার মধ্যে একমাত্র ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সারাদেশে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত দলীয় কার্যক্রম চালু আছে। এর বাইরে আর কোন দলেরই সাংগঠনিক কার্যক্রম এতটা বিস্তৃত নয়। এর বাইরে সাবেক সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির বেশ কিছু জেলায় বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের অনেকগুলো জেলায় শক্ত অবস্থান আছে।

প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলছিলেন, আওয়ামী লীগ প্রাচীন ও সবচেয়ে বড় দুটি দলের একটি। আর ক্ষয়িষ্ণু হলেও জাতীয় পার্টির বিভিন্ন ‘পকেট’ আছে যেসব এলাকায় দলটির অনেক ভোট আছে। ওই সব এলাকায় দলটির কার্যক্রম দেখা যায়।

বাকী দলগুলোর মধ্যে জাতীয় পার্টি-জেপি আনোয়ার হোসেন মঞ্জু কেন্দ্রিক আর বিকল্প ধারা বাংলাদেশ সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও তার ছেলে মাহি বি চৌধুরী কেন্দ্রিক। এবারের নির্বাচনে তারা নিজস্ব প্রতীক নিয়ে অংশ নিলেও মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে যোগসাজশ করেই নির্বাচন করছেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও মাহি বি চৌধুরী। এর বাইরে অন্য যে দলগুলো অংশ নিচ্ছে তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলো আছে। তবে তারা আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করছেন। এসব দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম খুবই সীমিত এবং কোন কোন ক্ষেত্রে নিতান্তই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। যেমন ওয়ার্কার্স পার্টি রাশেদ খান মেনন ভিত্তিক ও জাসদ (ইনু) হাসানুল হক ইনু ভিত্তিক। যদিও ওয়ার্কার্স পার্টির দুজন ও জাসদ(ইনু)র তিনজন এবার নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।

ওদিকে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম মূলত বিএনপির সাবেক কিছু নেতার সমন্বয়ে গড়া দল। তৃণমূল বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রয়াত বিএনপি নেতা নাজমুল হুদা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দলটি নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পেয়েছিলো। সাবেক বিএনপি নেতা শমসের মোবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকার সম্প্রতি দলটিতে যোগ দিয়ে আলোচনায় এসেছেন। তারাই এখন দলটির চেয়ারপার্সন ও মহাসচিব।

অন্যদিকে বিএনএম ও বিএসপি নিবন্ধন পেয়েছে গত অগাস্টে। বিএনএমের প্রতীক হলো নোঙর। আর বিএসপির প্রতীক একতারা। বিএনএম এই নির্বাচনে ৫৪টি আসনে আর বিএসপি ৭৯টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। তবে দেশের কোথাও এ দুটি দলের সাংগঠনিক কোন কার্যক্রম দেখা যায়নি। জাকের পার্টি সবসময়ই নির্বাচনে অংশ নেয় এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে সু সম্পর্ক বজায় রাখা দলটির ফরিদপুরের একটি আসনে বেশ কিছু সমর্থক আছে। অন্যদিকে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ মূলত কাদের সিদ্দিকী কেন্দ্রিক। আর সেসব ধর্মভিত্তিক দল এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে তারা ভোটের রাজনীতিতে এখন আর খুব একটা ভালো অবস্থানে নেই। ইসলামী ঐক্যজোট একসময় ভোট রাজনীতিতে গুরুত্ব পেলেও এখন এর একাংশ সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। কল্যাণ পার্টি একসময় বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিশ দলীয় জোটে থাকলেও এবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে হুট করেই অবস্থান বদল করে নির্বাচনে আসার ঘোষণা দেন দলটির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহীম। তিনি কক্সবাজার-১ আসন থেকে প্রার্থী হয়েছেন।

ওই আসনে আওয়ামী লীগ যাকে মনোনয়ন দিয়েছে তার মনোনয়নপত্র নির্বাচন কমিশন বাতিল করে দিয়েছেন। আবার ওই এলাকায় এখন যিনি সংসদ সদস্য তিনি আওয়ামী লীগের হলেও এবার দল থেকে মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। এর বাইরে বিএনএফকে গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঢাকায় একটি আসনে ছাড় দিলেও এবার দলটির কাউকে আওয়ামী লীগ আর সমর্থন দেয়নি। তারা ৪৫টি আসনে প্রার্থী দেয়ার কথা জানিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন ছাড়া এ দলটিরও কোথাও কোন তৎপরতা দেখা যায় না। একই পরিস্থিতিতে পড়েছে ১৪ দলীয় জোটে থাকা তরিকত ফেডারেশনও। গত নির্বাচনেও দলটির একজন প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে সংসদে এসেছিলেন কিন্তু এবার তাকে আর ছাড় দেয়নি আওয়ামী লীগ। দলটি ৩৮টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে।

ছোট হলেও গুরুত্বহীন নয়
ভোট বা সাংগঠনিক কার্যক্রমে দুর্বল হলেও ছোট ছোট দলগুলোর বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ভিন্ন ধরনের একটি গুরুত্ব আছে বলে মনে করেন দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নিয়ে কাজ করা প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। তার মতে, বিভিন্ন জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এসব দলকে নানা ভাবে সরকারের প্রয়োজনে ব্যবহার করে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা। বাংলাদেশের ভোটাররা দু’ভাগে বিভক্ত- আওয়ামী লীগ ও এন্টি-আওয়ামী লীগ। সব দল অংশ নিয়েছে এমন গত কয়েকটি নির্বাচনের ফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দু’পক্ষেই গড়ে ভোট পড়ার হার ৪০ শতাংশের মতো। ছোট ছোট দলগুলোর ভোট ও তৃণমূলে উপস্থিতি না থাকলেও বড় দলগুলোর সঙ্গে মিলে অনেক সময় তারা আলাদা গুরুত্ব তৈরি করে। আবার কখনো কখনো তাদের দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করিয়ে থাকে রাষ্ট্রযন্ত্র। এ কারণেই তারা আলোচনায় আসে।


সূত্র : বিবিসি বাংলা