ক্রিকেট

পাকিস্তান-ভারত; লড়াইয়ের ভেতরে লড়াই

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ১২:১৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২, ২০২৩

ভারত ও পাকিস্তান নিজেদের মধ্যে কোন দ্বিপাক্ষিক সিরিজ খেলেনি গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে। ২০১২ সালে সবশেষ ভারত সফর করেছিল পাকিস্তান। এরপর থেকে রাজনৈতিক কারণেই দু’দেশের সফর বন্ধ। তবে বহুজাতিক টুর্নামেন্টে তাদের প্রায়ই দেখা হয়, আয়োজকদের চেষ্টাও থাকে এমনভাবে সূচি তৈরির যাতে অন্তত এক বা একাধিক ম্যাচে মুখোমুখি হতে পারে এ দু’দল।

তেমনই এক সূচি অপেক্ষায় এশিয়া কাপে। শনিবার বিকেলে শ্রীলংকার ক্যান্ডিতে মুখোমুখি হচ্ছে দু’দল। যে ম্যাচ দিয়ে ৪ বছর পর ভারত-পাকিস্তানের ওয়ানডে লড়াই দেখবে দর্শকরা। বৃষ্টির চোখ রাঙানির মাঝেও এই ম্যাচ ঘিরে দর্শক আগ্রহ রয়েছে তুমুল। কারণ যখনই ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেটের ২২ গজে মুখোমুখি হয়, উত্তেজনার পারদ থাকে তুঙ্গে। দুদলেই থাকে বিশ্বসেরা সব ক্রিকেটার, মাঠে যারা উপহার দেন অসাধারণ সব পারফরম্যান্স। ফলে ভারত-পাকিস্তান লড়াই হয়ে পড়ে মহাকাঙ্খিত, সেটা যেমন দর্শকদের জন্য, তেমনি আয়োজক, স্পন্সর ও ব্রডকাস্টারদের জন্যও। এ ম্যাচেরও নানা দিক তাই যথারীতি আছে আলোচনায়।

লড়াইয়ের ভেতরে লড়াই
ভারত-পাকিস্তান যখন মুখোমুখি তখন সামনে আসে বেশ কিছু ব্যক্তিগত লড়াইও। দু’দলের দুই সেরা ব্যাটসম্যান বাবর আজম এবং ভিরাট কোহলি। এরই মধ্যে আসরের প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন বাবর আজম। নেপালের সাথে তার ১৫১ রান এশিয়া কাপ ইতিহাসের ২য় সর্বোচ্চ স্কোর। ওয়ানডেতে দ্রুততম ১৯টি সেঞ্চুরি করার রেকর্ড গড়েছেন বাবর আজম। এখন অধিনায়ক হিসেবে কোহলিকে ছাড়িয়ে দ্রুততম দুই হাজার রান করার হাতছানি আছে তার সামনে। ভারতের অধিনায়ক হিসেবে কোহলি ৩৬ ইনিংসে ২০০০ রান পূর্ণ করেছিলেন। পাকিস্তানের অধিনায়ক হিসেবে বাবর আজম ৩০ ইনিংসেই করে ফেলেছেন ১৯৯৪ রান। র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে থাকা এই ব্যাটার পাকিস্তানের ব্যাটিংয়ের মূল স্তম্ভ। ভারতের হয়েও একই অবস্থানে ভিরাট কোহলি, দলটির ব্যাটিং অর্ডারের প্রাণ তিনি। গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে যখন সর্বশেষ দু’দলের দেখা হয়েছিল, ভিরাটের অসাধারণ ব্যাটিং ভারতকে এক অবিশ্বাস্য জয় এনে দিয়েছিল। বর্তমানে খেলে যাওয়া ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক (৪৬টি) ভিরাট কোহলি এখন ১৩ হাজার ওয়ানডে রানের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে (১২৮৯৮ রান)।

বাংলাদেশের সাবেক ক্রিকেটার ও বিশ্লেষক রকিবুল হাসানও মনে করেন, এই দু’জনের দিকেই আজ আলাদা নজর থাকবে ক্রিকেট বিশ্বের। বিশ্ব ক্রিকেটে এ দুজনই ব্যাটিংয়ে এখন একেবারে সামনের কাতারে। তাদের মধ্যে যে সক্ষমতা আছে, তারা একাই ম্যাচের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিতে পারে। তাই এ দু’জনের ব্যাটের দিকে যে দর্শকরা চেয়ে থাকবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভিরাট কোহলি ও বাবর আজমের ব্যাটিংয়ের উপর যেমন দু’দল অনেক বেশি নির্ভরশীল, তেমনি এ দু’জনকেই সামলাতে হবে বিশ্বসেরা বোলিং অ্যাটাক। একদিকে পাকিস্তানের পেসত্রয়ী শাহিন শাহ, হারিস রউফ ও নাসিম শাহ। অন্যদিকে ভারতের পেস বোলিংয়ের নেতৃত্ব দেবেন মোহাম্মদ সিরাজ, জসপ্রিত বুমরাহ ও মোহাম্মদ শামি। এছাড়া স্পিনে ভারতের প্রধান ভরসা হবেন রবীন্দ্র জাদেজা, আর পাকিস্তানের শাদাব খান।

তবে রকিবুল হাসান মনে করেন, লড়াইটা পাকিস্তান বোলার বনাম ভারতের ব্যাটারদের। দুদলেই বিশ্বসেরা সব বোলার আছে। তবে তুলনা করে পাকিস্তানের বোলিং একটু এগিয়ে থাকবে। আবার ভারতের আছে লম্বা ব্যাটিং লাইন আপ, দারুণ সব নাম আছে তাদের ব্যাটিংয়ে। কিন্তু পাকিস্তান বাবর-রিজওয়ানসহ ৩-৪ জনের উপর নির্ভরশীল। তবে যারা ভালো ও গোছালো বল করবে তারাই শেষ পর্যন্ত জিতবে।

দু’দলের চিন্তার জায়গা
ভারত-পাকিস্তান হাই ভোল্টেজ ম্যাচে শেষ পর্যন্ত খেলোয়াড়দের ফর্মের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে টেম্পারমেন্ট। অর্থাৎ এরকম ‘বিগ ম্যাচে’ কে কতটা নার্ভ ধরে রাখতে পারছেন, ঠান্ডা মাথায় স্নায়ুর পরীক্ষায় কীভাবে চাপ সামাল দিচ্ছেন, সেটাই পার্থক্য গড়ে দেবে ম্যাচে।

রকিবুল হাসান বলেন, এটা আসলে চাপের খেলা, দু’দলের কাছে মর্যাদার লড়াই, কে সেই চাপ ভালোভাবে সামলায় সেটাই দেখার।তবে এই চাপটা ভারতের উপর বেশি, কারণ তাদের ক্রিকেট ফ্যানদের প্রত্যাশাও বেশি। ভারতও অনেকদিন হল পারফরম্যান্সে খুব ভালো জায়গায় নেই। তাদের জয়-পরাজয়ের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে।

এ ম্যাচে ভারতের যত দুশ্চিন্তা টপ অর্ডার ঘিরেই। মুখোমুখি হওয়া গত কয়েকটি ম্যাচেই পাকিস্তানি পেসাররা দ্রুত তুলে নিয়েছেন ভারতীয় টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের। তার উপর ইনজুরিতে ছিটকে গেছেন লোকেশ রাহুল। তার বদলি হতে লড়ছেন দুই উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান ইশান কিষাণ এবং সাঞ্জু স্যামসন। ওপেনিংয়ে অধিনায়ক রোহিত শর্মার সঙ্গী হবেন দারুণ ফর্মে থাকা শুভমান গিল। ভিরাট কোহলির পর ভারতের মিডল অর্ডার নিয়ে খানিকটা দুশ্চিন্তা রয়েই যাচ্ছে। যদিও ইনজুরি থেকে শ্রেয়াস আইয়ারের ফেরা খানিকটা স্বস্তি দিচ্ছে দলকে। এছাড়া শেষদিকে হার্দিক পান্ডিয়ার ব্যাটের দিকে চেয়ে থাকবে টিম ইন্ডিয়া।

অন্যদিকে পাকিস্তানের শক্তির জায়গা বাবর, রিজওয়ান আর ফখর জামানকে নিয়ে টপ অর্ডার। তবে দুশ্চিন্তা হঠাৎ ভেঙে পড়া মিডল অর্ডার নিয়ে। যদিও সেই দুশ্চিন্তা কিছুটা ঘুচিয়েছে গত ম্যাচে ইফতিখার আহমেদের ঝড়ো সেঞ্চুরি। এছাড়া ব্যাট হাতে শেষদিকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন শাদাব খানও। শেষ পর্যন্ত লড়াইটা আসলে দুদলের টপ অর্ডার আর পেসারদের মধ্যে।

মুখোমুখি পরিসংখ্যান
ওয়ানডে ক্রিকেটে ১৩২তম বারের মতো মুখোমুখি হচ্ছে পাকিস্তান ও ভারত। যাতে ৭৩ জয় পাকিস্তানের, আর ভারতের জয় ৫৫ ম্যাচে। তবে গত ৫ ম্যাচে পাকিস্তান জিতেছে মাত্র একবার, সেটাও ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে। তবে সবশেষ এশিয়া কাপের লড়াইয়ে দুদলে সমতা। ২০২২ টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপের গ্রুপপর্বে পাকিস্তানকে ৫ উইকেট হারায় ভারত। আর সুপার ফোরে ভারতকে ৫ উইকেটে হারিয়ে ফাইনাল খেলে পাকিস্তান। তবে এশিয়া কাপের সর্বোচ্চ ৭টি শিরোপা আছে ভারতের, শেষটি ২০১৮ সালে। পাকিস্তান এশিয়া কাপ জিতেছে দুইবার, ২০০০ এবং ২০১২ সালে।

বৃষ্টিতে যদি খেলাই না হয়!
এই শঙ্কাই এখন সবচেয়ে বেশি। শ্রীলঙ্কার আবহাওয়া বিভাগ বলছে ক্যান্ডিতে শনিবার সারাদিনই থেমে থেমে বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে। সেই সাথে ঝড়ো বাতাস ও বজ্রও থাকবে। বিবিসির আবহাওয়া ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে ,ক্যান্ডিতে এদিন বৃষ্টির সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত আছে। তাপমাত্রা নেমে যেতে পারে সর্বনিম্ন ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। সাধারণত অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে শ্রীলংকায় ক্রিকেট খেলা অনুষ্ঠিত হয় না। কিন্তু এবার এশিয়া কাপের হাইব্রিড মডেল নিয়ে শেষ মূহুর্তের সিদ্ধান্তে বৃষ্টির সময় দেশটিতে খেলা আয়োজন করা হচ্ছে।

পাল্লেকেলে স্টেডিয়ামের দর্শক ধারণক্ষমতা ৩৫ হাজার। স্বাভাবিকভাবেই সূচী ঘোষণার পর থেকেই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের টিকিট নিয়ে বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে। খেলা পরিচালনার জন্য স্টেডিয়ামের মাঠকর্মীদের এদিন ব্যস্ত সময় পার করা লাগতে পারে। চেষ্টা থাকবে বৃষ্টি হানা দিলে কমপক্ষে ২০ ওভার করে ম্যাচ আয়োজনের। আর সেটাও সম্ভব না হলে পয়েন্ট ভাগাভাগি করতে হবে দুদলকে। যা নিশ্চিত করবে পাকিস্তানের সুপার ফোরে ওঠা। আর ভারতকে অপেক্ষা করতে হবে সোমবার নেপালের সঙ্গে ম্যাচ পর্যন্ত।

ভারতের আপত্তিতে আয়োজক পাকিস্তানকে খেলতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কায় এবারের এশিয়া কাপ মাঠে গড়ানোর আগেই শুরু হয়ে যায় পাক-ভারত উত্তেজনা।

এশিয়া কাপের অভিভাবক এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল। যার প্রেসিডেন্ট আবার জয় শাহ, যিনি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডেরও সেক্রেটারি। পূর্বঘোষিত সূচী অনুযায়ী এবারের পুরো আসর পাকিস্তানে হবার কথা থাকলেও বেঁকে বসে ভারত। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে টুর্নামেন্ট আয়োজন। শেষ পর্যন্ত হাইব্রিড মডেলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের এশিয়া কাপ। যাতে মূল আয়োজক পাকিস্তানের ভাগে পড়েছে মাত্র ৪টি ম্যাচ, আর ৯টি ম্যাচ হচ্ছে শ্রীলংকায়। ফলে বুধবার মুলতানে নেপালের সঙ্গে ম্যাচ শেষেই শ্রীলংকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে হয়েছে পাকিস্তান দলকে। যা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ অভিযোগ করছেন পাকিস্তানি ভক্তরা।

তবে রকিবুল হাসান মনে করেন, দুদেশের দর্শকদের মধ্যে উত্তেজনা থাকলেও, খেলোয়াড়দের মধ্যে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সম্প্রীতি দেখা যায়। বুমরাহ বনাম বাবর কিংবা শাহিন শাহ বনাম রোহিত শর্মাদের মাঠে লড়াই চলে বন্ধুত্বের আবহে।

ভারত পাকিস্তানে খেলতে না গেলেও এশিয়া কাপের বিশেষ ডিনারের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। বিসিসিআই সভাপতি রজার বিনি তার সহ সভাপতি রাজিব শুক্লাকে নিয়ে লাহোরে যাবার কথা রয়েছে।