ক্রিকেট

এশিয়া কাপে দলগুলোর শক্তি ও দুর্বলতা যেখানে

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ১:১৩ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৩০, ২০২৩

বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক ক্রিকেটপ্রেমীর কাছেই বিশ্বকাপের চেয়ে অনেক বেশি পছন্দের আসর এশিয়া কাপ। খেলাকে কেন্দ্র করে সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের কথার লড়াই, এক দেশকে কটাক্ষ করে আরেক দেশের মিডিয়ার বিদ্বেষ উদগার বা খেলা নিয়ে রাজনীতির মাঠে কথার ঝড় তোলা – এর কিছুই বাদ যায় না এশিয়া কাপে। তার ওপর ক্রিকেটের সবচেয়ে আলোচিত দ্বৈরথের – ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যকার ম্যাচ – কারণে এশিয়া কাপের দিকে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়, সারা বিশ্বের ক্রিকেট ফ্যানরা আগ্রহ নিয়ে নজর রাখে। এবারের এশিয়া কাপ সেই হিসেবে আরো বেশি জমজমাট হবে, কারণ এবার দুই সপ্তাহের মধ্যে তিনবার ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ওয়ানডে বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে এই টুর্নামেন্টকে নিশ্চিতভাবে বিশ্বকাপের আগের ড্রেস রিহার্সেল হিসেবে দেখবে বাংলাদেশ সহ বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া বাকি দলগুলো।

‘হাইব্রিড মডেল’ টুর্নামেন্ট
১৯৮৪ সাল থেকে শুরু হওয়ার পর এবারই প্রথম ‘হাইব্রিড মডেল’এ খেলা হবে এশিয়া কাপ, অর্থাৎ স্বাগতিক হিসেবে খেলা আয়োজন করবে দুই দেশ। প্রাথমিকভাবে পুরো আসর পাকিস্তানে আয়োজিত হওয়ার কথা থাকলেও দুই দেশের রাজনৈতিক বৈরিতার জের ধরে ভারত পাকিস্তানে খেলতে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। এর জবাবে পাকিস্তান হুমকি দেয় যে টুর্নামেন্টের আয়োজক হতে না দিলে তারা অক্টোবরে ভারতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্বকাপ বর্জন করবে। এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশের যৌথ আয়োজনে টুর্নামেন্টের এই হাইব্রিড মডেল অনুমোদন করে এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল।টুর্নামেন্টের ১৩টি ম্যাচের মধ্যে চারটি হবে পাকিস্তানের দুই ভেন্যু মুলতান আর লাহোরে। ফাইনালসহ বাকি ৯টি ম্যাচ হবে শ্রীলঙ্কার পাল্লেকেলে আর কলম্বোতে। ভারত পাকিস্তান ম্যাচ ছাড়াও আরো একাধিক দ্বৈরথ এবারের এশিয়া কাপে উত্তেজনা ছড়াতে পারে। আফগানিস্তান আর পাকিস্তানের মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও দুই দেশের সমর্থকদের বৈরিতার প্রকাশ হয় এই দুই দলের ম্যাচের সময়। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় হওয়া দুই দলের সিরিজের মধ্যেও খেলোয়াড়দের লড়াই শুধু ব্যাট-বলে সীমাবদ্ধ ছিল না। বাংলাদেশের সাথে শ্রীলঙ্কার খেলোয়াড়-সমর্থকদের স্নায়ুর লড়াইটাও মাঠের খেলায় যে প্রভাব ফেলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফিতে দুই দলের ম্যাচের শেষে বাংলাদেশ টিমের খেলোয়াড়দের ‘নাগিন ড্যান্স’ উদযাপন ও তার পরের উত্তপ্ত পরিস্থিতি নি:সন্দেহে দুই দেশের সমর্থকরা এখনো ভুলে যাননি। যদিও শ্রীলঙ্কার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ার আগে সংবাদ সম্মেলনে অধিনায়ক সাকিব আল হাসান শ্রীলঙ্কা বা আফগানিস্তানের সাথে বিশেষ দ্বৈরথের বিষয়টি নাকচ করে দেন। পাশাপাশি টুর্নামেন্টে নিজেদের প্রথম ম্যাচের আগে মাঠের বাইরের স্নায়ুর খেলার চেয়ে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কার দুই দলের প্রধান লক্ষ্য থাকবে ইনজুরিতে জর্জরিত দলকে সংগঠিত করা।

বাংলাদেশ
টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার মাসখানেক আগেই নিয়মিত অধিনায়ক ও অভিজ্ঞ ব্যাটসম্যান তামিম ইকবালকে ঘিরে নানা নাটকীয়তা দলের মানসিকতায় স্পষ্টতই প্রভাব ফেলেছে। শেষ পর্যন্ত তামিম এশিয়া কাপে খেলবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন। অধিনায়ক তামিমের অভিজ্ঞতা ও ব্যাটসম্যান তামিমের সার্ভিস স্বাভাবিকভাবেই এই টুর্নামেন্টে মিস করবে বাংলাদেশ। শেষ মুহুর্তের ইনজুরিও যথেষ্ট চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দলের জন্য। শ্রীলঙ্কায় যাত্রা করার কয়েকদিন আগে ইনজুরিতে আসর থেকে ছিটকে যান ফর্মে থাকা বোলার এবাদত হোসেন। আর অসুস্থতার কারণে শেষমুহুর্তে দলের সাথে প্লেনে ওঠেননি লিটন দাস। লিটন দাস টুর্নামেন্টে খেলতে পারলেও ৩১শে অগাস্ট প্রথম ম্যাচের আগে সুস্থ হতে পারবেন কিনা সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। তার জায়গায় অভিষেক হতে পারে বাঁহাতি তানজিদ তামিমের। বাংলাদেশ দলের প্রধান শক্তির জায়গা নাসুম, সাকিব, মিরাজদের নিয়ে তৈরি দলের স্পিন বোলিং অ্যাটাক। তাসকিন, হাসান মাহমুদ, মুস্তাফিজ, শরিফুলদের পেস অ্যাটাকও বেশ আশা জাগানিয়াই বলতে হয়।

দলের দুর্বলতা লোয়ার মিডল অর্ডারের ব্যাটিং। সাত নম্বর ব্যাটিং পজিশনে আফিফ, শামীম, শেখ মাহেদি, মিরাজদের নাম উঠে এসেছে বারবার। এর মধ্যে শুধু মিরাজই পরীক্ষিত পারফর্মার, অন্যদের ধারাবাহিকতার অভাব পরিসংখ্যানে স্পষ্ট। তবে বাংলাদেশ ছাড়ার আগে কোচ চান্দিকা হাথুরুসিংহে জানান যে গত দুই মাস টেইল এন্ডাররা আলাদাভাবে ব্যাটিং প্র্যাকটিস করেছেন। তাই তাসকিন, শরিফুল, মুস্তাফিজদের কাছ থেকে ব্যাট হাতেও কিছু ঝলক দেখার আশা করতেই পারেন সমর্থকরা। বোলিং অ্যাটাকের হিসেবে টুর্নামেন্টে অন্য দলগুলোর সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য হল – একমাত্র বাংলাদেশ দলেই কোনো লেগ স্পিনার নেই। পাকিস্তান, আফগানিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল সবারই অন্তত একজন ডানহাতি লেগ স্পিনার রয়েছে। ভারত দলে ডানহাতি না থাকলেও বাঁহাতি লেগ স্পিনার বা চায়নাম্যান রয়েছেন একজন।

শ্রীলঙ্কা
সবচেয়ে বেশি ইনজুরি জর্জরিত দল হিসেবে এই টুর্নামেন্টে অংশ নিতে যাচ্ছে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা। পেসার দুষ্মন্ত চামিরা, দিলশান মাদুশাঙ্কা ও লাহিরু কুমারার বাদ পড়া টুর্নামেন্টের আগেই নিশ্চিত ছিল। কিন্তু টুর্নামেন্টের ছয় বারের চ্যাম্পিয়নদের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা হিসেবে আসে অলরাউন্ডার ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গার ইনজুরি। দারুণ ফর্মে থাকা এই স্পিন অলরাউন্ডার পুরো টুর্নামেন্টে জন্য বাদ না পড়লেও বাংলাদেশ আর আফগানিস্তানের সাথে গ্রুপ পর্বের গুরুত্বপূর্ণ দুই ম্যাচে যে তিনি খেলতে পারবেন না, তা একরকম নিশ্চিত। তার ওপর শেষ মুহুর্তে কোভিড পজিটিভ হয়ে খেলা অনিশ্চিত হয়ে গেছে কুশল পেরেরার। তিনি আদৌ খেলতে পারবেন কিনা, তা এখনও জানায়নি শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট বোর্ড।

শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং লাইনআপে বিশ্বমানের একাধিক ব্যাটসম্যান থাকলেও তাদের সাম্প্রতিক পারফরমেন্সে ধারাবাহিকতার যথেষ্ট ঘাটতি দেখা গেছে। এক পাথুম নিসাঙ্কা বাদে গত এক বছরে ধারাবাহিক পারফর্ম করতে পারেননি লঙ্কান দলের কোনো ব্যাটসম্যানই। তবে অধিনায়ক দাসুন শানাকা, কুশল মেন্ডিস, চারিথ আসালঙ্কারা প্রত্যেকেই বড় ইনিংস খেলে ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয়ার সামর্থ্য রাখেন। শ্রীলঙ্কা দলে এই টুর্নামেন্টে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন লেগ স্পিনার মাহিশ থিকসানা। এছাড়া বিশ বছর বয়সী মাহিশা পাথিরানার দিকেও নজর থাকবে সবার। বয়সে আর অভিজ্ঞতায় ছোট হলেও ‘বেবি মালিঙ্গা’ হিসেবে পরিচিত এই বোলার এবারের আইপিএলে চোখে পড়ার মত পারফর্ম করেছেন।

ভারত
এশিয়া কাপের সাতবারের চ্যাম্পিয়ন ভারত সবসময়ই অন্যতম ফেভারিট হয়ে এই আসরে অংশ নেয়। এবারও সেটির ব্যতিক্রম হচ্ছে না। চিরাচরিতভাবেই ভারতের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা দলের লম্বা ব্যাটিং লাইনআপ। রোহিত শর্মা, ভিরাট কোহলির মত সুপারস্টারদের পাশাপাশি তরুণ সেনসেশন সুরিয়াকুমার ইয়াদাভ, শ্রেয়াস আইয়ার, শুভমান গিলরা প্রত্যেকেই ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পরীক্ষিত পারফর্মার।অলরাউন্ডার ডিপার্টমেন্টেও অন্য যে কোনো দলের চেয়ে বেশি খেলোয়াড় রয়েছে ভারতের। হার্দিক পান্ডিয়া, রবীন্দ্র জাদেজা, অক্ষর প্যাটেল, শার্দুল ঠাকুররা ব্যাট ও বল দুই বিভাগেই যথেষ্ট শক্তিশালী। তবে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে অধিনায়ক রোহিত শর্মা বলেছিলেন যে ব্যাটিং এ ভূমিকা রাখতে পারে, এমন বোলার দলে রাখতে চান তিনি। সেক্ষেত্রে একাদশ নির্ধারণের সময় চার স্পেশালিস্ট বোলার জাসপ্রিত বুমরাহ, কুলদীপ ইয়াদাভ, প্রাসিধ কৃষ্ণা ও মোহাম্মদ সিরাজের মধ্যে কোন একজনকে হয়তো বাদ পড়তে হবে। পুরো ফিট স্কোয়াড নিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করার সম্ভাবনা থাকলেও টুর্নামেন্টের আগে ইনজুরিতে পড়েছেন ভারতের উইকেটকিপার লোকেশ রাহুল। তার জায়গায় ইশান কিষানকে দেখা যেতে পারে সেরা একাদশে।

পাকিস্তান
পাকিস্তান এই টুর্নামেন্টে যাচ্ছে আইসিসি ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষ দল হিসেবে। ফলাফল নিয়ে তাদের প্রত্যাশাটা স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা বেশি থাকবে। দুইবারের চ্যাম্পিয়নদের সবচেয়ে বড় শক্তি নি:সন্দেহে তাদের পেস অ্যাটাক। শাহীন শাহ আফ্রিদি, হারিস রউফ আর নাসিম শাহ ত্রয়ীকে বর্তানে শুধু এশিয়ার নয়, বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর পেস বোলিং আক্রমণ বললেও অত্যুক্তি করা হবে না। ব্যাটিংয়েও পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় রয়েছেন যারা নিয়মিত পারফর্ম করে যাচ্ছেন। ইমাম উল হক, ফখর জামান, বাবর আজম, মোহাম্মদ রিজওয়ান বা ইফতিখার আহমেদ – প্রত্যেকেই দলের প্রয়োজনে বড় ও কার্যকর ইনিংস খেলার প্রমাণ দিয়েছেন। অলরাউন্ডার শাদাব খান ও মোহাম্মদ নাওয়াজের সাম্প্রতিক ফর্মও বেশ ভালো। সাম্প্রতিক সময়ে কম সংখ্যক ওয়ানডে খেলা পাকিস্তানের একমাত্র দুর্বলতা মনে করা হচ্ছে। ২০১৯ বিশ্বকাপের পর থেকে চার বছরে তারা ওয়ানডে খেলেছে মাত্র ৩১টি, যার মধ্যে ১২টিই ছিল জিম্বাবুয়ে, নেদারল্যান্ডস, আফগানিস্তানের মত তুলনামূলক দুর্বল দলে সাথে।

আফগানিস্তান
পরিসংখ্যান ও ইতিহাসের বিচারে দল হিসেবে আফগানিস্তান তুলনামূলক ছোট দল হলেও হলেও নিজেদের দিনে তারা যে বড় দলের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ তারা বারবার দিয়েছে। তাদের দলে রশিদ খান, মুজিব-উর রহমান, রাহমানুল্লাহ গুরবাজের মত অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা রয়েছেন যাদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে টি-টোয়েন্টি লিগে খেলার অভিজ্ঞতা আছে। পাশাপাশি রয়েছে মোহাম্মদ নবী, হাশমাতুল্লাহ শহীদী’র মত দীর্ঘ সময় ধরে দলের সাথে থাকা অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। বিশেষ করে গুরবাজ তার অল্প দিনের ওয়ানডে ক্যারিয়ারিই নিজের সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছে। মাত্র ২৪ ম্যাচ খেলে ২১ বছর বয়সী এই ব্যাটসম্যান এরই মধ্যে ৫টি সেঞ্চুরি ও দুইটি হাফসেঞ্চুরি করেছেন, গত সপ্তাহে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজেও তার পারফরমেন্স ছিল দেখার মত। আফগানিস্তানের বোলিং ডিপার্টমেন্টের মূল শক্তি দুই স্পিনার রশিদ খান ও মুজিব-উর-রহমান। রশিদ খান যদিও ওয়ানডেতে টি-টোয়েন্টির মত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন না। তবে ওয়ানডেতে তার ইকোনমি রেট ৪.১৫, আধুনিক ক্রিকেটে যেটিকে দূর্দান্ত বলা চলে। মুজিব-উর-রহমানের ইকোনমি রেটও একই রকম।

নেপাল
প্রথমবারের মত এশিয়া কাপ খেলতে আসা নেপাল এই টুর্নামেন্টকে হয়তো অভিজ্ঞতা অর্জনের মঞ্চ হিসেবেই বিবেচনা করবে। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা বা বাংলাদেশের সাথে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা হয়নি নেপালের। মূলত, আইসিসি’র সহযোগী এই দেশ এখন পর্যন্ত খুব কম পূর্ণ সদস্য দেশের সাথেই আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে। তাদের দলের সবচেয়ে বড় তারকা লেগ স্পিনার সান্দীপ লামিছানে, যিনি ২০১৮ সালে আইপিএলে খেলেছেন। ক্রিকেটে দুই এশিয়ান হেভিওয়েট ভারত ও পাকিস্তানের সাথে একই গ্রুপে থাকা নেপাল হয়তো এই টুর্নামেন্টে সম্মানজনক পরাজয়েই সন্তুষ্ট থাকবে।