বিবিধ

রাজনীতিতে উত্তরাধিকার বা পরিবারতন্ত্র কি আরো বিস্তৃত হলো?

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ৩:৪৮ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩

রাজনীতিতে সক্রিয় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোতে পরিবারতন্ত্র পুরনো বিষয় হলেও এবারের সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এটি আরও বিস্তৃতি লাভ করেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে গত ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে এবার নতুন করে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের অনেকেই দলটির পুরনো নেতাদের ছেলে বা মেয়ে। তাদের কেউ বাবার মৃত্যুর কারণে আবার কেউ বাবার অসুস্থতা বা বার্ধক্যজনিত নিষ্ক্রিয়তার কারণে রাজনীতিতে এসেছেন। এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপিও মনোনয়নের ক্ষেত্রে অনেক জায়গায় প্রয়াত কিংবা বয়োবৃদ্ধ নেতাদের সন্তানদের বেছে নিয়েছিলো।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলছেন, দলগুলোতে গণতন্ত্রের চর্চা না থাকা এবং দেশে স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া না থাকার কারণেই কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত পরিবারতন্ত্র প্রকট আকার ধারণ করছে।

আরেকজন বিশ্লেষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ড. মামুন আল মোস্তফা বলছেন, পার্টির প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে বড় দলগুলো তাদের সাবেক নেতাদের ছেলে মেয়েদের প্রতি বেশি ভরসা করছে বলেই সর্বস্তরে পরিবারতন্ত্রের বিকাশ ঘটছে।

তবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা অবশ্য বলছেন, নেতাদের ছেলে মেয়ে হিসেবে কাউকে পদ দেয়া যায় কিন্তু নেতা বানানো যায় না, ফলে নেতা হতে হলে তাদেরকেও রাজনৈতিক যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয়।

পরিবারতন্ত্র: আওয়ামী লীগে
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে এখন দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার একক কর্তৃত্ব এবং তার নিকটাত্মীয়দের অনেকেই দলটিতে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন পর্যায়ে উঠে এসেছেন। এবারের নির্বাচনেও তার আত্মীয়দের অনেকে দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। এর বাইরে দলটির প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ও আব্দুল জলিল, আব্দুর রাজ্জাক ও মোহাম্মদ নাসিমসহ অনেকের সন্তানরা আগেই এমপি হয়েছেন। এবার নতুন করে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের মধ্যে কারো কারো পিতা ৭০ ও ৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। আবার কারো কারো পিতা বার্ধক্যজনিত কারণে আর রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে পারছেন না। ঝিনাইদহ-৩ আসনে দলটির মনোনয়ন পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সালাউদ্দিন মিয়াজী। তার বাবা ৭০ ও ৭৩ সালে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করেছিলেন। এবার দলীয় এমপিকে মনোনয়ন না দিয়ে আওয়ামী লীগ মিয়াজীকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছে। নেত্রকোনার একটি আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব সাজ্জাদুল হাসান। তার বাবাও গণপরিষদ সদস্য ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। চট্টগ্রাম- ১ আসনে দলটির মনোনয়ন পেয়েছেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে মাহবুব রহমান রুহেল আর চট্টগ্রাম ২ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির প্রয়াত এমপি রফিকুল আনোয়ারের কন্যা খাদিজাতুল আনোয়ার। আবার দলের কোষাধ্যক্ষ আশিকুর রহমানের আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন তার ছেলে রাশেক রহমান। প্রয়াত সাবেক ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ মোহিত উর রহমান মনোনয়ন পেয়েছেন ময়মনসিংহ-৪ আসনে। আবার ঢাকা-৫ আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন হাজী সেলিমের ছেলে মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিম। গাজীপুর -৩ আসনে মনোনয়ন পাওয়া রুমানা আলী দলের প্রয়াত নেতা রহমত আলীর মেয়ে। অন্যদিকে সুনামগঞ্জ-২ আসনে মনোনয়ন পাওয়া চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বর্তমান আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের ভাই এবং তাদের পিতা সুনামগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এর বাইরেও দলের এমপি ছিলেন ও আছেন এবং এবারেও মনোনয়ন পেয়েছেন যাদের পিতা আওয়ামী লীগের এমপি বা বড় নেতা ছিলেন।

দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য নূহ উল আলম লেনিন বলছেন, আওয়ামী লীগ প্রায় শতাব্দী প্রাচীন দল এবং সে কারণে এই চিত্র স্বাভাবিক। বাংলাদেশে একজন কোন দল করলে পুরো পরিবার সেই দলের হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের পুরনো বা আগের নেতারা অনেক অবদান রেখেছেন।সে হিসেবে তাদের সন্তানদের এমনি একটি অবস্থান জনমনে তৈরি হয়ে গেছে। ফলে এটি অস্বাভাবিক কোন বিষয় নয়।

যদিও আবুল কাশেম ফজলুল হক বলছেন সঠিক বা সব দলের অংশগ্রহণে একটি ভালো পরিবেশে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগেও এমন পরিস্থিতি হতো না। এখন দলের নেতারা জানে যাকে দিবেন তিনিই হয়ে যাবেন, ফলে কেউ আর ভাগ ছাড়তে চাইছে না।

যদিও পিতা বা পরিবারের সূত্র ধরে যারা মনোনয়ন পেয়েছেন তারা বিষয়টি এভাবে দেখতে রাজী নন। মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সালাউদ্দিন মিয়াজী বলছিলেন, তার পিতার পরিচয় তাকে সুবিধা দিলেও চাকুরী থেকে অবসরের পর থেকেই তিনি এলাকায় কাজ করেছেন এবং জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন। আমার পিতা একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং ৭০ ও ৭৩ এর এমপি। আমার বাবার পরিচয় ও তার জনসমর্থন আমাকে দলীয় সমর্থন ও প্রধানমন্ত্রীর আস্থা অর্জন করতে সুবিধা করে দিয়েছে। কিন্তু আমিও সততার সাথে কাজ করে প্রশংসিত হয়েছি চাকুরি জীবনেই। অবসরের পর থেকেই এলাকার মানুষের সাথে আছি। জনসম্পৃক্ততা আমার আগেই ছিলো। এসব যোগ্যতার জন্যই প্রধানমন্ত্রী হয়তো আমার ওপর আস্থা রেখেছেন।

পরিবারতন্ত্র ও বিএনপি
বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপিতে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের পর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেছিলেন। এরপর খালেদা জিয়ার ভাই বোনসহ আত্মীয়দের অনেকে মন্ত্রী ও এমপি হয়েছিলেন। এখন দলটির কর্তৃত্ব তার সন্তান তারেক রহমানের হাতে। এছাড়া দলীয় মহাসচিব মীর্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সহ অনেক নেতার পিতাই বিএনপির শুরুর দিকেই দলটির সাথে যুক্ত হয়ে মন্ত্রী এমপি হয়েছিলেন। তবে দলেরর অন্য স্তরে পরিবারতন্ত্র বা নেতাদের উত্তরাধিকারদের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দেয় ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময়। বিশেষ করে ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দলটির অনেক নেতার বিভিন্ন মামলায় কারাদণ্ড হলে তারা নির্বাচনের অযোগ্য হয়ে পড়েন।

বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, ওই সময় আমাদের বেশ কিছু নেতার পরিবারের সদস্যদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছিলো সংশ্লিষ্ট আসনটিতে জয় নিশ্চিত করার জন্য। কারণ এসব নেতা নিজ নিজ এলাকায় বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। আবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার সন্তানদের প্রার্থী হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিলো কারণ ওই নেতারা বয়সের কারণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিলেন বা নির্বাচনে অংশ নেয়া সম্ভবপর ছিলো না। তবে সব ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। আমার এলাকায় সাবেক হুইপ ও দলেরই সাবেক এমপিকে না দিয়ে দল আমাকে মনোনয়ন দিয়েছিলো। এভাবে অনেক জায়গায় নতুন প্রার্থীও বেছে নিয়েছিলো আমাদের দল।

অবশ্য এটিও সত্যি যে দলটির বয়স যত বাড়ছে দলে সাবেক নেতাদের ছেলে মেয়েদের প্রভাবও বাড়ছে। দলের পদ বা মনোনয়নের ক্ষেত্রেও তাদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পঞ্চগড়ের একটি আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন বিএনপি আমলে সংসদের স্পীকার ও দলটির অন্যতম প্রভাবশালী নেতা জমির উদ্দিন সরকারের ছেলে নওশাদ জমির।

নওশাদ জমির অবশ্য বলেছেন, বিএনপিতে তার পিতার অবস্থান তাকে কিছুটা সুবিধা দিলেও তিন দশক তিনি নিজেও সক্রিয় থেকে দলে অবস্থান তৈরি করেছেন। আমাদের মতো রাজনৈতিক পরিবারগুলোর ছেলে মেয়েরা এমনিতেই রাজনীতিতে জড়িয়ে যায়, জনগনের সাথে সম্পর্ক হয়ে যায়। তবে কেউ যদি একেবারেই রাজনীতিতে না থাকে আর নির্বাচন এলে পিতার পরিচয়ে দলের প্রার্থী হয়ে যায় সেটি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

পরিবারতন্ত্রের জাল কেনো বিস্তৃত হচ্ছে
রাজনৈতিক নেতারা যাই বলুন বাস্তবতা হচ্ছে আগে শুধু জাতীয় পর্যায়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার পরিবারসহ হাতে গোনা কয়েকটি পরিবারকেই পরিবারতন্ত্র হিসেবে বোঝানো হতো। এখন এমপি ছাড়াও উপজেলা চেয়ারম্যান কিংবা পৌরসভার মেয়র হিসেবেও এমন অনেকে এসেছেন তাদের পিতা হয়তো সেই পদে ছিলেন একসময়।

আবুল কাশেম ফজলুল হক বলছেন, এর বড় কারণই হলো স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া না থাকা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থাকলে দল থেকেই অন্যরা উঠে আসার সুযোগ পেতো। নেই বলেই পরীক্ষিত কর্মীর বদলে নেতার পরিবারের সদস্যরা গুরুত্ব পাচ্ছে। সে কারণেই সব পর্যায়েই পরিবারতন্ত্র দেখা যাচ্ছে।

ড. মামুন আল মোস্তফা বলছেন, পরিবারতন্ত্র বিস্তৃত হওয়ার আরেকটি কারণ হলো রাজনৈতিক পরিবারগুলোর সদস্যরা ছোট বেলা থেকেই এক ধরনের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ পেয়ে যায়, ফলে তারা নিজ এলাকাতেই রাজনীতিতে এমনিতেই এগিয়ে থাকে। এছাড়া সাম্প্রতিক কালে দুই প্রধান দলেই যোগ্যতা ও আদর্শের চেয়ে, আনুগত্যের প্রশ্নটি বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। আর পার্টির প্রতি আনুগত্যের মাপকাঠি হিসেবে পুরনোরা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ দল ভাবছে তার পূর্বপুরুষ যেহেতু অনুগত ছিলো সেও এর বাইরে যাবে না। এসব কারণেই শুধু এমপি বা জনপ্রতিনিধি না এমনকি বড় দলগুলোর সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রেও পরিবারতন্ত্র বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে।

আবুল কাশেম ফজলুল হক বলছেন, পরিবারতন্ত্রের বিস্তার ঠেকাতে হলে এক জনের দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হবার সুযোগ বন্ধ করতে হবে।

বিএনপি নেতা নওশাদ জমির অবশ্য মনে করেন শুধু প্রধানমন্ত্রী না, এমপি হওয়ার ক্ষেত্রেও কারও দুবারের বেশি সুযোগ থাকা উচিত নয়।