বলিউড

১৯৭১-এর ২২ নভেম্বরের যে ঘটনা নিয়ে বলিউড সিনেমা তৈরি হয়

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ১২:৪৯ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৫, ২০২৩

দমদম বিমানবন্দর, ২২ নভেম্বর, ১৯৭১। ঘড়িতে তখন দুপুর ২টা ৩৭ মিনিট। হঠাৎ মাইকে ঘোষণা হল ‘স্ক্র্যাম্বেল, স্ক্র্যাম্বেল’। বিমানবাহিনীর পাইলট মাত্রই জানেন এই ঘোষণার অর্থ, তক্ষুনি দৌড়তে হবে নিজের বিমানের দিকে, আকাশে উড়তে হবে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই নিজেদের ন্যাট যুদ্ধবিমান নিয়ে আকাশে উড়েছিলেন ফ্লাইয়িং অফিসার ডোনাল্ড লাজারুস আর ফ্লাইয়িং অফিসার সুনীথ সুয়ারেস। আরও দুটি ন্যাট বিমান নিয়ে একই সঙ্গে আকাশে উড়েছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট রয় মেসি আর এম এ গণপতি। মেদিনীপুরের কলাইকুণ্ডা বিমান ঘাঁটি থেকে তাদের ২২ স্কোয়াড্রনকে আগেই নিয়ে আসা হয়েছিল দমদমে। ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে বেনাপোলের কাছে কপোতাক্ষ নদীর ধারে বয়রার আকাশে পৌঁছতে নয় মিনিট লেগেছিল চারটি বিমানের। ভারতের আকাশ সীমায় সে সময়ে ঢুকে পড়েছিল পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর তিনটি স্যাবার যুদ্ধ বিমানের। তিনটি পাকিস্তানি বিমানকেই ধ্বংস করে ভারতীয় বাহিনী। সেই যুদ্ধ বিখ্যাত হয়ে আছে ‘বয়রার আকাশ যুদ্ধ’ নামে। সেই যুদ্ধের বর্ণনা বিবিসিকে দিয়েছেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন হিসাবে ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়া তখনকার ফ্লাইয়িং অফিসার ডোনাল্ড লাজারুস, যিনি ডন লাজারুস হিসাবেই সতীর্থদের কাছে বেশি পরিচিত। তবে তার আগের কয়েক দিনের ঘটনা প্রথমে শোনাবো।

গরীবপুরের যুদ্ধ
বয়রার আকাশে যখন ভারতীয় আর পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর যুদ্ধ চলছে, নীচে, ওই অঞ্চলেই, পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের ভেতরে এক অখ্যাত গ্রাম গরীবপুরে তার আগের ২৪ ঘণ্টা ধরে পাকিস্তানি আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে ভয়াবহ লড়াই চলেছিল। সেই লড়াই ‘গরীবপুরের যুদ্ধ’ নামে চিহ্নিত হয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে। অধ্যাপক মুনতাসির মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষে লেখা হয়েছে, যশোর সেনানিবাস থেকে ১১ কিলোমিটার এবং ভারত সীমান্ত থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত অখ্যাত গ্রাম গরীবপুর। গরীবপুরে ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ করলে উভয় পক্ষের মধ্যে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

ওই যুদ্ধে রাশিয়ায় তৈরি পিটি-৭৬ ট্যাঙ্ক স্কোয়াড্রনের নেতৃত্ব প্রধান মেজর দলজিৎ সিং নারাং যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হওয়ার পরেই বাহিনীর দায়িত্ব বর্তায় সেইসময়ে ক্যাপ্টেন বলরাম সিং মেহতার ওপরে। সম্মুখ সমরে পাকিস্তানী স্কোয়াড্রনের ১৪টি ট্যাঙ্কের সবগুলি ধ্বংস করে ভারতীয় বাহিনী। পাকিস্তানী বাহিনীর বহু সৈন্যও নিহত ও আহত হন, আর ভারতীয় বাহিনীর ১৯ জন নিহত, ৪৪ জন আহত হন ও দুটি ট্যাঙ্ক সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়, লেখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ কোষে। এই গরীবপুরের যুদ্ধের সত্য ঘটনার ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছে সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া বলিউডের ছবি ‘পিপ্পা’। সিনেমাটির কাহিনী নেওয়া হয়েছে গরীবপুর যুদ্ধে অংশ নেওয়া ট্যাঙ্ক বাহিনীর অধিনায়ক, সেই সময়ে ক্যাপ্টেন, পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার, বলরাম সিং মেহতার বই ‘দ্য বার্ণিং চ্যাফিস’ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে নির্মিত এম টুয়েন্টি ফোর চ্যাফিস ট্যাঙ্ক সেই সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ব্যবহার করত। ওই সিনেমাতেই সুর বদল করে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় গান ‘কারার ওই লৌহ কপাট’।

যশোর পর্যন্ত রাস্তা সাফ রাখার পরিকল্পনা
সেই প্রথম ভারতীয় সেনা বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা অতিক্রম করে যুদ্ধ করে। ৭১-এর যুদ্ধে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করার তখনও ১১ দিন বাকি। যদি পুরোপুরি যুদ্ধেই যেতে হয়, তার প্রস্তুতি হিসাবে যশোর পর্যন্ত রাস্তা পাকিস্তানি বাহিনীর দখল মুক্ত করে রাখা দরকার ছিল ভারতীয় বাহিনীর। সেই দায়িত্ব পড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আর পিটি-সেভেন্টি সিক্স ট্যাঙ্ক সহ ৪৫ ক্যাভালরির ‘সি’ স্কোয়াড্রনের ওপরে।ওই অঞ্চলটি ছিল মুক্তিবাহিনীর আট নম্বর সাব সেক্টরের এলাকা। মাঝে মাঝেই সীমানা অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে আবার ভারতে ফিরে আসতেন মুক্তিযোদ্ধারা। অন্যদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের দায়িত্ব ছিল এই সেক্টর রক্ষা করার, আর যশোর রক্ষার জন্য রাখা ছিল তাদের ১০৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড। ‘পিপ্পা’ সিনেমার কাহিনী যার বইয়ের ওপরে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে, সেই অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার বলরাম সিং মেহতা ছাড়াও গরীবপুরের যুদ্ধ নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল বিজয় যশওয়ন্ত গিধ। মনোহর পার্রিকর ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিস প্রকাশিত ‘১৯৭১ ইণ্ডিয়া – পাকিস্তান ওয়ার, ফিফটি ইয়ার্স লেটার’ গ্রন্থে কর্ণেল গিধের ওই প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল। কর্ণেল গিধ লিখছেন, “আক্রমণ করার একদিন আগে ১৯-২০শে নভেম্বর রাতে ১৪ পাঞ্জাবের একটি দলকে সীমান্ত পেরিয়ে রেকি করতে পাঠানো হয়।এখানে ১৪ নম্বর পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কথা বলা হয়েছে। “১৪ পাঞ্জাব ২০শে নভেম্বর সকাল সাতটায় এগোতে শুরু করে,” লিখেছেন কর্ণেল গিধ।

শুরুতেই নৌকাডুবি
পরিকল্পনা মতো ২০শে নভেম্বর সকাল সাতটাতেই ১৪ পাঞ্জাব রওনা হয় গরীবপুরের উদ্দেশ্যে। তবে মাঝে কপোতাক্ষ নদ পেরতে হবে বাহিনীকে। সেনা কারিগরী বিভাগ ৪০ মিটার লম্বা একটা সেতু বানাচ্ছিল বটে, কিন্তু বাহিনী নদীর তীরে পৌঁছে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত হয় যে, এখন মোটরবোটে করে পার করিয়ে দেওয়া হবে সৈন্যদের। সেনা কারিগরী বিভাগের একটি ১৬ আসনের মোটরবোট আর একটা ‘ক্লাস-৫ র‍্যাফ্ট’ ছিল যেটিতে সর্বাধিক ২০ জন চড়তে পারেন। কর্ণেল বিজয় যশওয়ন্ত গিধ লিখছেন, প্রথম দলটি ৯.৩০ মিনিট নাগাদ রওনা হয় কপোতাক্ষ নদ পেরনোর উদ্দেশ্যে। তাদের সঙ্গে ‘মিডিয়াম মেশিন গান’ ছিল। নৌকাটিতে ১৬ জন সেনা সদস্য চেপেছিলেন। নদীর অপর পাড়ে যেখানে থামার কথা ছিল মোটরবোটটির, সেখানে থামাতে পারেন নি চালক। হঠাৎ করে একটা ইউ-টার্ন নেন চালক আর নৌকাটি উল্টে গিয়ে ডুবে যায়। আগাছা ভর্তি জলের মধ্যে উল্টে যাওয়া নৌকাটির নীচেই আটকে পড়েন সেনা সদস্যরা। সাঁতার কেটে বাঁচার চেষ্টা করছিলেন সবাই। দুই ডুবুরি সঙ্গে সঙ্গেই জলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু মাত্র সাতজনকে উদ্ধার করা গিয়েছিল, নয়জন ডুবে যান।

গরীবপুরে ভারতীয় সেনা
বাহিনীর বাকি সদস্যরা মুষড়ে পড়েছিলেন শুরুতেই এরকম একটা দুর্ঘটনার ফলে। তবে ধীরে ধীরে সাবধানতা অবলম্বন করে সবাইকে সন্ধ্যার মধ্যেই নদী পার করিয়ে দেওয়া হয়।  রাতের মধ্যেই ১৪টি পিটি-সেভেন্টি সিক্স ট্যাঙ্ক সহ ৪৫ ক্যাভালরির ‘সি’ স্কোয়াড্রন আর ১৪ পাঞ্জাবের পদাতিক সেনা গরীবপুর পৌঁছিয়ে যায়। একেবারে শেষে বাহিনীর সেকেণ্ড-ইন কমাণ্ড মেজর ইন্দরজিৎ সিং রাত ১০টা ৩০ মিনিট নাগাদ পৌঁছন। “মাঝ রাত নাগাদ মেজর ডিএস নারাং তার ট্যাঙ্কগুলিকে জায়গা মতো সাজিয়ে নিয়েছিলেন। আলফা কোম্পানি (পদাতিক বাহিনীর) যে জায়গায় অবস্থান নিয়েছিল, সেখানে ট্যাঙ্ক বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন তেজিন্দর সিং সিধু। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থান নিয়েছিল ক্যাপ্টেন বিএস মেহতার ট্যাঙ্ক বহর, যেখানে ডেল্টা কোম্পানি মোতায়েন করা হয়েছিল” ওই যুদ্ধে মেজর নারাংয়ের মৃত্যু হয় আর তারপরে ক্যাপ্টেন বিএস মেহতাই গরীবপুর যুদ্ধে ট্যাঙ্ক বাহিনীর নেতৃত্ব দেন আর তিনিই হলেন ‘পিপ্পা’ সিনেমার অন্যতম কাহিনীকার, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার বলরাম সিং মেহতা। পরের দিন, ২১শে নভেম্বর, খুব ভোর থেকে হামলার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল ভারতীয় বাহিনী।

পাক বাহিনীর কাছে খবর চলে যায়
লড়াইয়ের শেষে যুদ্ধ বন্দী হিসাবে ভারতীয় বাহিনীর হাতে আটক হওয়া পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ খানকে যখন জেরা করা হয়, তখন জানা যায় যে তাদের কাছে খবর গিয়েছিল যে এক কোম্পানি ভারতীয় বাহিনী পিতম্বরপুর রোডে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু গরীবপুরে যে একটা গোটা ভারতীয় ব্যাটালিয়ন ঢুকে গেছে, সেটা তিনি আন্দাজ করতে পারেন নি। যে ভারতীয় বাহিনীর তিনি খবর পেয়েছিলেন, সেটা আসলে ছিল মেজর এনজিএস বৈঁসের নেতৃত্বাধীন ‘চার্লি কোম্পানি’। ব্রিগেডিয়ার খান তার পদাতিক বাহিনীর সঙ্গে চ্যাফিস ট্যাঙ্ক সহ ‘৩ ইণ্ডিপেণ্ডেন্ট আর্মার্ড স্কোয়াড্রন’-কে পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় বাহিনীকে দক্ষিণ আর দক্ষিণ পশ্চিম দিক থেকে ঘিরে ফেলতে, যাতে তারা ভারতীয় সীমান্তের দিকে পালিয়ে না যেতে পারে। জেরায় এও জানিয়েছিলেন তিনি যে জাতিসংঘকে এটা দেখাতে চেয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খান যে যুদ্ধ শুরু না হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানের সীমানার ভেতরে ভারতীয় বাহিনী ঢুকে পড়েছে। আগে, অন্যত্রও এই প্রচেষ্টা চালিয়েছে পাকিস্তানী বাহিনী।

কলকাতায় যে আট নম্বর থিয়েটার রোডের বাড়িতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার কাজ চালাতো, সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল আনন্দবাজার পত্রিকার অবসরপ্রাপ্ত সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তর। তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন যে ওই ভবনের ঠিক উল্টো দিকের একটি হোটেলে পাকিস্তানী সামরিক গুপ্তচর বাহিনী আইএসআইয়ের এক এজেন্ট হোটেলের আবাসিক হিসাবে ঘর নিয়েছিলেন। “আট নম্বর বাড়ির অনেক ছবি তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সেই সব ছবিতে দেখা গিয়েছিল যে ভবনটির বাইরের নিরাপত্তায় মোতায়েন রয়েছে বিএসএফ সদস্যরা। তারপর পাকিস্তান আর অনেক আন্তর্জাতিক পত্র পত্রিকায় বড় করে ছবি দিয়ে খবর ছাপা হয়েছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে কোনও মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে না, ভারতের কলকাতা থেকে এটা পরিচালিত হচ্ছে।“

‘পাক-বাহিনী অগ্রসর হচ্ছে’
ভারতীয় বাহিনীর সেকেণ্ড-ইন-কমাণ্ড মেজর ইন্দরজিৎ সিংয়ের আশঙ্কা ছিল যে পাকিস্তানী বাহিনী কোনওভাবে তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে আগাম হামলা চালাতে পারে। কর্ণেল গিধকে তিনি এক সাক্ষাতকারে জানিয়েছিলেন, এমএমজি (মিডিয়াম মেশিন গান) অফিসার ক্যাপ্টেন জিএস গিল আর ৬ ফিল্ড রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন পিপি চতুর্বেদীকে উত্তর দিকে সিংহঝুলি-উত্তর জগন্নাথপুর অঞ্চলে পাঠানো হয়েছিল যাতে যশোর-চৌগাছা রাস্তা দিয়ে শত্রুপক্ষ আসছে কী না, তার ওপরে নজর রাখা যায়। রাত সাড়ে তিনটে নাগাদ নজরদার দল দেখতে পায় যে পাকিস্তানী বাহিনী অগ্রসর হচ্ছে। যশোরের দিক থেকে আসা ট্যাঙ্ক বহরের গর্জন শুনতে পেয়েই তারা খবর পাঠায় সদর দপ্তরে। যদিও ওয়্যারলেসে কথা বলা নিষেধ ছিল, তবুও ক্যাপ্টেন গিল ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে রেডিও সেটে পাঞ্জাবি ভাষায় খবর দেন, “স্যার, ইত্থে দুশমন দে বহোত ট্যাঙ্কস তে ইনফ্যান্ট্রি একাত্থে হো রহে নে”, অর্থাৎ, স্যার, এখানে শত্রুপক্ষের প্রচুর ট্যাঙ্ক আর পদাতিক বাহিনী এগিয়ে আসছে দেখতে পাচ্ছি। নির্দেশ মতো তারপর তার ওয়্যারলেস আবারও নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল।

অবিশ্বাস্য ট্যাঙ্ক যুদ্ধ
গরীবপুরে ২১শে নভেম্বরের সেই ভোরে কুয়াশা পড়েছিল। তারমধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর চারটি কোম্পানি বিভিন্ন দিকে নিজেদের অবস্থান নিয়েছিল। পাকিস্তানী বাহিনী শুধুমাত্র ‘চার্লি কোম্পানি’-র অবস্থানের খবর পেয়েছিল। কিন্তু আরো যে তিনটি দলে ভাগ হয়ে রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সদস্যরা আর তাদের সঙ্গে রয়েছে ট্যাঙ্ক বাহিনী, সেটা তারা আঁচ করতে পারে নি। চারটি দলের অন্যতম ডেল্টা কোম্পানির নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন বলবীর সিং। দিনের আলো তখন সবে ফুটতে শুরু করেছে। সেদিনের কথা মনে করে তিনি জানিয়েছেন, “৪৫ ক্যাভালরির ‘সি’ কোম্পানির ট্যাঙ্কগুলোতে সওয়ার হয়ে আমরা এগোতে থাকি। গরীবপুর গ্রামের বাইরে পর্যন্ত কোনও শত্রু সেনার মুখোমুখি হতে হয় নি।

“নিজেদের অবস্থান ঠিক করে নেওয়ার জন্য দিনের আলোয় মিনিট পনেরো সময় পেয়েছিলাম আমরা। শত্রুপক্ষের ট্যাঙ্কগুলো দ্রুত বেগে ধেয়ে আসছিল আমাদের দিকে। আমরা যে ওখানে অবস্থান নিয়েছি, এটা না বুঝেই ট্যাঙ্কগুলো এগিয়ে আসছিল। সামনের দিকের দুটো ট্যাঙ্ক তো আমাদের ২৫ মিটারের মধ্যে চলে এসেছিল। তখন তারা আমাদের দেখতে পায়। ট্যাঙ্কের নলগুলো আমাদের দিকে ঘোরাতে শুরু করে তারা,” জানাচ্ছেন ক্যাপ্টেন বলবীর সিং। তিনি বলছেন, “ট্যাঙ্কে-ট্যাঙ্কে যুদ্ধ চোখের সামনে দেখা এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। তারা ট্যাঙ্কের নল আমাদের দিকে ঘোরাতে শুরু করেছিল, কিন্তু তার আগেই আমাদের ট্যাঙ্ক থেকে গোলাবর্ষণ শুরু হয়। শত্রুপক্ষের সেনারা ট্যাঙ্ক থেকে লাফ দিয়ে বেরতে চেষ্টা করলেই আমরা আঘাত করছিলাম। যারা মারা গিয়েছিল, তাদের মধ্যে ছিলেন শত্রুপক্ষের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট ভাট। পেছনে যে ট্যাঙ্কগুলো আসছিল, তাদের রুখে দিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন বিএস মেহতা আর ক্যাপ্টেন তেজিন্দার সিধু। কয়েক মিনিটের মধ্যে শত্রুপক্ষের সব ট্যাঙ্কগুলিতে আগুন লেগে গিয়েছিল,” স্মৃতিচারণ করেছেন ক্যাপ্টেন বলবীর সিং।

ওই লড়াইয়ের মাঝেই নিজের ট্যাঙ্কগুলোকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন মেজর ডিএস নারাং। পাকিস্তানি চ্যাফি ট্যাঙ্কগুলো তখন একেবারে কাছে চলে এসেছে। দুটো পাকিস্তানি চ্যাফি ট্যাঙ্ককে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। কিন্তু তার গুলি লাগে। যুদ্ধক্ষেত্রেই নিহত হন ট্যাঙ্ক বহরের প্রধান মেজর নারাং। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ক্যাপ্টেন বিএস মেহতা ট্যাঙ্ক বহরের নেতৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে নেন। এই কথা নিজেই লিখেছেন ‘পিপ্পা’ সিনেমার অন্যতম কাহিনীকার ব্রিগেডিয়ার মেহতা।

ফতিমাকে উর্দুতে লেখা চিঠি
‘শত্রুপক্ষ’ ততক্ষণে পিছু হঠতে শুরু করেছে। মেজর ইন্দরজিৎ সিং একটা গাছের পেছনে এক পাকিস্তানি জুনিয়র কমিশন্ড অফিসারকে দেখতে পান। মেজর ইন্দরজিৎ বলেন, তাকে আমাদের কাছে নিয়ে আসা হয়। আমাদের ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে জানান যে তিনি মৃত। কিছুক্ষণ পরে ওই অফিসার চোখ খুলে তাকালেন, চারদিকে দেখলেন, তারপরে সত্যিই তিনি মারা গেলেন। আমরা তাকে তল্লাশি করে উর্দুতে লেখা একটা চিঠি খুঁজে পেলাম। স্ত্রীকে লেখা ওই চিঠিতে লেখা ছিল, “ফতিমা, আমরা তো নিজের দেশে ফিরতে পারলে তবেই ঈদ পালন করতে পারব। আগে তো বাঙালীরা মারছিল, এখন তো হিন্দুস্তানি সেনাবাহিনীও আমাদের আক্রমণ করছে।“ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ কোষে হিসাব দেওয়া হয়েছে সম্মুখ সমরে পাকিস্তানী স্কোয়াড্রনের ১৪টি ট্যাঙ্কের সবগুলি ধ্বংস করে ভারতীয় বাহিনী। পাকিস্তানী বাহিনীর বহু সৈন্যও নিহত ও আহত হন, আর ভারতীয় বাহিনীর ১৯ জন নিহত, ৪৪ জন আহত হন ও দুটি ট্যাঙ্ক সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়

বয়রার আকাশ যুদ্ধ
পাকিস্তানী বাহিনী সেদিন পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু পরের দিন, ২২শে নভেম্বর সকালে তিনটে এফ-এইট্টি সিক্স স্যাবর যুদ্ধবিমান হাজির হয় গরীবপুরের আকাশে। বোমাবর্ষণ করতে থাকে ভারতীয় স্থল সেনা আর ট্যাঙ্ক বহরের ওপরে। একটা ভারতীয় পিটি-সেভেন্টি সিক্স ট্যাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও কিছু ভারতীয় সৈন্য আহত হন। এরপরে দুপুর পৌনে তিনটে নাগাদ আরও তিনটে পাকিস্তানী বিমান সেখানে হাজির হয়। এগুলির মোকাবেলা করতেই দমদম বিমানবন্দর থেকে চারটি ন্যাট বিমান নিয়ে রওনা হয়েছিলেন ফ্লাইয়িং অফিসার ডন লাজারুস ও তার সতীর্থরা। তিনি বলেছেন, আমরা ন্যাট নিয়ে ওদের একটা বিমানের পিছু নিয়েছিলাম। প্রায় দেড়শো গজ দূর থেকে ফায়ার করি। অল্পই গুলি চালিয়েছিলাম। আমার নল থেকে মাত্র ১২টা গুলি চলেছিল, তখনই স্যাবর বিমানটাতে আগুন ধরে যায়। আমি রেডিওতে চিৎকার করে বলেছিলাম ‘আই গট হিম, আই গট হিম’। আমার ওড়ার পথেই স্যাবরটিতে বিস্ফোরণ হয় এতটাই কাছে বিস্ফোরণ হয়েছিল যে ওই বিমানটার কিছু টুকরো আমার ন্যাট বিমানে এস লাগে।

নীচে, ভারতীয় এলাকায় সেসময়ে বাহিনী নিয়ে হাজির ছিলেন ক্যাপ্টেন এইচএস পানাগ। তিনি বলেছেন, একবার তো মনে হচ্ছিল যে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী আমাদের থামানোর জন্য তার পুরো স্কোয়াড্রন মোতায়েন করে দিল নাকি। কিন্তু তারপরে চারটি যুদ্ধবিমান একেকটি স্যাবের বিমানের পিছু নিল। আমি জিপে করে যাচ্ছিলাম। জিপ থামিয়ে ওই আকাশ যুদ্ধ দেখছিলাম। তিনি দেখতে পান যে দুটি স্যাবর ভেঙ্গে পড়ছে আর দুটি প্যারাসুট নিয়ে বৈমানিকরা ঝাঁপ দিয়েছেন। ক্যাপ্টেন পানাগ স্মৃতিচারণ করে বলেন, “আমাদের সৈন্যরা বাঙ্কার থেকে বেরিয়ে প্যারাসুটের দিকে দৌড়ে যায়। আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমাদের সৈন্যরা পাকিস্তানী পাইলটদের মারধর করতে পারে। প্রথমে আমি আমার জিপটি নিয়ে সেদিকে ধেয়ে যাই, একসময়ে জিপ থেকে নেমে দৌড়তে থাকি। আমি যখন ৫০ গজ দূরে ছিলাম, তখন দেখলাম আমাদের সৈন্যরা পাইলটকে নামিয়ে রাইফেলের বাট দিয়ে মারছে। আমি চিৎকার করে তাদের থামতে বললাম। আমি একজন পাইলটের শরীরের ওপরে শুয়ে পড়ে তাকে মার খাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করি।“

ভবিষ্যতের পাক বিমান বাহিনী প্রধান যুদ্ধবন্দী
যে দুজন পাকিস্তানী পাইলট সেদিন ধরা পড়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজনের নাম ছিল ফ্লাইয়িং অফিসার পারভেজ মেহদী কুরেশি। ৭১-এর যুদ্ধে কুরেশিই প্রথম যুদ্ধবন্দী হয়েছিলেন। কলকাতায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয় ফোর্ট উইলিয়াম হয়ে পরবর্তী দেড় বছর গোয়ালিয়রে যুদ্ধবন্দী হিসাবে কাটাতে হয় তাকে। তার বন্দী হওয়ার ছবি আর সংবাদ ভারতের পত্রপত্রিকায় বড় করে ছাপা হয়েছিল। সেই বৈমানিক মি. কুরেশিকে অনেক বছর পরে একটি চিঠি লিখেছিলেন ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকে অবসর নেওয়া গ্রুপ ক্যাপ্টেন ডন লাজারুস। সেই চিঠিটা অবশ্য লেখা হয়েছিল পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর সদ্য নিযুক্ত প্রধানের উদ্দেশ্যে। মুক্তিযুদ্ধের অনেক বছর পরে, ১৯৯৬ সালে পারভেজ মেহদী কুরেশি, বয়রার যুদ্ধে বন্দী হওয়া সেই পাকিস্তানী পাইলট পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর প্রধান হিসাবে নিযুক্ত হন।  লাজারুস তার চিঠিতে লিখেছিলেন, “আপনার হয়তো মনে নেই, কিন্তু আপনার সঙ্গে আগে একবার আমার দেখা হয়েছিল, আকাশ পথে।“

ওই চিঠির উত্তর আশা করেননি  লাজারুস। তবে মি. কুরেশির এক স্টাফ অফিসার চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করেছিলেন। তবে মি. লাজারুসের বিস্মিত হওয়ার আরও কিছু বাকি ছিল। স্বয়ং পাকিস্তানী বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল পারভেজ মেহদী কুরেশি নিজে সই করা একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন সেই ডন লাজারুসকে, যিনি ১৯৭১এর ২২শে নভেম্বর তার বিমান ধ্বংস করেছিলেন, যুদ্ধবন্দী হতে হয়েছিল মি. কুরেশিকে। গরীবপুর আর বয়রার যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু ২২শে নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের সীমানার ভেতরে ঢুকে যে যুদ্ধে জিতেছিল মিত্রবাহিনী, তার ইতিহাস মূলত ভারতীয় সামরিক ইতিহাসকারদের লেখাতেই বিশদে পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ কোষেও এর উল্লেখ আছে, তবে খুব বড় করে নয়।

এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ কোষের সম্পাদক অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলছিলেন, ৩ ডিসেম্বরের আগে অনেক কিছুই হয়েছে বেসরকারিভাবে। সহায়তা হিসাবে তেসরা ডিসেম্বরের আগে সীমান্ত হয়তো অতিক্রম করেছে ভারতীয় বাহিনী, সেটা লুকনোর কিছু নেই। অনানুষ্ঠানিকভাবে অস্ত্র সরবরাহ করা, প্রশিক্ষণ দেওয়া, সহায়তাকারী হিসাবে মুক্তিবাহিনীর পাশে থাকা, সবই করেছে ভারতীয় বাহিনী। কিন্তু আসল লড়াইটি মুক্তিবাহিনীই লড়েছিল নয় মাস ধরে। সেটাকে অনেকেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলে তুলে ধরতে চেষ্টা করেন, যা রাজনৈতিক ইতিহাসে সঠিক শব্দচয়ন নয়।


সূত্র : বিবিসি বাংলা