প্রযুক্তি

এআই যেভাবে হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনার পূর্বাভাস করতে পারে

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ৩:৪২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৩

বুকে একটা চিন চিন করা ব্যথা? ডাক্তাররা বলেন, ব্যথাটাকে গ্যাস বা অ্যাসিডিটির ব্যথা বলে ধরে না নিয়ে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে পৌঁছতে হবে, কারণ হার্ট অ্যাটাকের পরে প্রথম এক ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চিন চিন করা ব্যথা হওয়ারও অনেক আগে আপনি নিজেই ইঙ্গিত পেতে পারেন যে আপনার হৃদযন্ত্র ঠিক মতো কাজ করছে কি না। এর জন্য আপনাকে না হতে হবে বিশেষজ্ঞ, না দরকার ইসিজি মেশিনের মতো যন্ত্র। কিছু বিশেষ ব্র্যান্ডের স্মার্টওয়াচ, স্মার্টফোন বা ডিজিটাল স্টেথোস্কোপের মতো সহজে পাওয়া যায় এমন কিছু যন্ত্র, যা দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সাহায্যেই আগাম ইঙ্গিত পাবেন যে আপনার হৃদযন্ত্র ঠিকঠাক চলছে কি না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হৃদরোগের চিকিৎসায় কী কী অবদান রাখতে পারে, তা নিয়ে আলোচনার জন্য কলকাতায় এখন চলছে তিন দিনের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন। কার্ডিওলজিকাল সোসাইটি অফ ইণ্ডিয়া আয়োজিত ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, রাশিয়া সহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে গবেষক-চিকিৎসকরা এসেছেন।

এআই যখন সাধারণ মানুষের হাতে
ওই সম্মেলনেই যোগ দিতে এসেছেন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. মিন্টু তুরাখিয়া। তিনি একদিকে যেমন হৃদযন্ত্রের ‘ছন্দপতন’-এর চিকিৎসা করেন, তেমনই বিখ্যাত এক ব্র্যাণ্ডের স্মার্টওয়াচের মাধ্যমে কী করে হৃদযন্ত্রের কোনও ত্রুটির আগাম ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তা নিয়ে একটি বড় গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন।

ডা. তুরাখিয়া ব্যাখ্যা করছিলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করে এমন একধরণের যন্ত্র আছে যেগুলো চিকিৎসকরাই শুধু ব্যবহার করতে পারেন। ইসিজি, হার্ট মনিটর প্যাচ, এমনকি এক্স-রে বিশ্লেষণ করার জন্যও এআই ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো কোনও না কোনও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ছাড়পত্র পাওয়া যন্ত্র। চিকিৎসকরা এইসব যন্ত্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে আরও নিখুঁত চিকিৎসা করতে পারেন। আরেক ধরণের যন্ত্রও আছে, যেখানে এআই ব্যবহার করা হয়, কিন্তু আসলে সেগুলো ভোগ্যপণ্য। অ্যাপল ওয়াচের মতো স্মার্ট ওয়াচ বা সাধারণের ব্যবহারযোগ্য ইসিজির মতো ভোগ্যপণ্যগুলি কোনও চিকিৎসক ছাড়াই ইসিজি বিশ্লেষণ করে জানিয়ে দিতে পারে যে হৃদযন্ত্রে কোনও সমস্যা আছে কি না। এই সফ্টওয়ারগুলো অবশ্য সব দেশে এখনও ব্যবহার করা হয় না। একটি বিখ্যাত ব্র্যাণ্ডের স্মার্ট ওয়াচে এরকম একটা ফিচারও যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে ওই হাত ঘড়ির পিছনে একটি আলো থাকে।

ডা. তুরাখিয়া বোঝাচ্ছিলেন, ওই আলোর বিন্দুটির মাধ্যমেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হিসাব কষে বলে দিতে পারে যে ওই ব্যক্তির নাড়ির গতি স্বাভাবিক আছে কি না। অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন মানেই কোনও একটা সমস্যা আছে তার হৃদযন্ত্রে। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইসিজি আর চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে। এমনকি স্মার্টফোনের ফ্ল্যাশ লাইটের ওপরে আঙ্গুল রেখেও হৃৎস্পন্দন মাপা যায়, এরকম অ্যাপও রয়েছে। আবার রোবোটিক সার্জারি প্রযুক্তিও অনেক হাসপাতালেই শুরু হয়েছে। সেখানেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ওই সার্জারিতে খরচ বিপুল।

দাম ধরাছোঁয়ার বাইরে
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে যেসব যন্ত্র আসছে, তা চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুমোদিত হোক বা স্মার্টওয়াচ, স্মার্টফোনের মতো ভোগ্যপণ্য হোক, সেগুলির এখনও যা দাম, তা ভারতের মতো দেশের সিংহভাগ মানুষেরই ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিষয়টি স্বীকার করছেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরাও।

তবে ওই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের কোঅর্ডিনেটর ডা. কাজল গাঙ্গুলি বলছিলেন, এআই ব্যবহার করে যেসব যন্ত্র বা ব্যবস্থাপনা হৃদরোগের আগাম সতর্কতা দিতে পারে, তার বেশিরভাগই এখনও পরীক্ষা নিরীক্ষার পর্যায়ে আছে। কিছু যন্ত্র বাজারে এসেছে, সেগুলোর দামও অনেকটাই বেশি ভারতের মতো দেশের মানুষের কাছে। কিন্তু আমরা আশা করব যে বাজারের সূত্র মেনেই যত বেশি এধরণের যন্ত্র বাজারে আসবে, মানুষ কিনতে থাকবেন, ততই দামও কমবে। তখন আরও বেশি মানুষের সাধ্যের মধ্যে চলে আসবে এআই যন্ত্রগুলি।

অন্য একটি সমাধান দিচ্ছেন ডা. মিন্টু তুরাখিয়া। তিনি বলছিলেন, “ভারতের মতো দেশে ১০ বা ১৫ বছরের মধ্যে আমরা হয়তো এরকম কিছু ব্যবস্থার কথা ভাবতে পারি যে একেকটা ছোট গুমটি মতো করা হল – অনেকটা আগে যেরকম টেলিফোনের বুথ থাকত। ওই বুথগুলিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে, এমন বেশ কিছু যন্ত্র থাকল। সাধারণ মানুষ সেখানে গিয়ে নিজেই নাড়ির গতি, ইসিজি বা রক্তে শর্করার পরিমাপের মতো পরীক্ষা করে নিলেন। এআই যন্ত্র যদি কোনও ইঙ্গিত দেয়, তাহলে ওই ব্যক্তি চিকিৎসকের কাছে গেলেন সঠিক ভাবে রোগ নির্ণয়ের জন্য।

তার ব্যাখ্যা এক্ষেত্রে কোনও একজন ব্যক্তি যদি বেশি খরচ করে এআই ‘গ্যাজেট’ নাও কিনতে পারেন, তিনি প্রাথমিক ইঙ্গিতটা পেয়ে যেতেই পারেন ওইসব বুথে রাখা যন্ত্রগুলির মাধ্যমে। তবে চিকিৎসকরা বারবার সাবধান করছেন যে এআই হয়তো প্রাথমিক সতর্কতাটা জানাল। কিন্তু তারপরে চিকিৎসাটা কিন্তু ডাক্তারই করবেন। তিনিও আবার এআইয়ের সহায়তা হয়তো নেবেন। কিন্তু যন্ত্র কখনই চিকিৎসকের বিকল্প নয়, একটা সহায়ক মাত্র।

পশ্চিমবঙ্গে পাইলট প্রকল্প
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এআই নিয়ে সারা বিশ্বে যেমন গবেষণা চলছে, তেমনই কাজ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতেও। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ডি পি সিনহা বলেন, পশ্চিমবঙ্গের ১৫টি জেলার ১৫০টি স্কুলে একটি পাইলট প্রকল্প শেষ হয়েছে, যেখানে ডিজিটাল স্টেথোস্কোপ ব্যবহার করে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক আছে কি না, সেই তথ্য জানতে পারছেন শিক্ষিকারাই। তার পরে কম্পিউটারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআইয়ের মাধ্যমে সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে তা পাঠানো হচ্ছে চিকিৎসকদের কাছে। শিশুদের মধ্যে যে রোগটা খুবই দেখা যায়, সেই রিউম্যাটিক হার্ট ডিজিসের আশঙ্কা কতটা আছে একটি শিশুর, সেটার ইঙ্গিত এর মাধ্যমে পাওয়া যাবে।কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে হৃদরোগের আগাম ইঙ্গিত পাওয়া গেলে হার্ট অ্যাটাকের যত ঘটনা ভারতে ঘটে, তা ১৮% মতো কমিয়ে আনা যেতে পারে, এমনটাই দেখা যাচ্ছে গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে। কিন্তু এই তথ্য এখনও খুবই প্রাথমিক স্তরেই রয়েছে।