১৮ জুন, ২০২৫

ধ্বংসযজ্ঞ আর প্রাণহানি বাড়ছে, নেই থামানোর উদ্যোগ

ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে ধ্বংসযজ্ঞ আর প্রাণহানি বেড়ে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ বাড়ছে। কিন্তু সংঘাত থামানোর কোনো উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান নয়। আন্তর্জাতিক মহলের প্রকাশ্য তৎপরতা নিন্দা আর উদ্বেগ জানানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বরং ইরানের ওপর ইসরায়েলের হামলা আরও জোরদার হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তেল আবিবের প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

সংঘাতের পঞ্চম দিনে গতকাল মঙ্গলবার ইরান দাবি করেছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের সদর দপ্তরে আঘাত হেনেছে। আর ইসরায়েল দাবি করেছে, তাদের হামলায় ইরানের যুদ্ধকালীন নতুন সামরিক প্রধান আলী শাদমানি নিহত হয়েছেন। এ তথ্য সত্যি হলে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে তেহরানের সামরিক বাহিনীর নিহত হওয়া কর্মকর্তার সংখ্যা হবে ১০৯ জন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন ১২৩ জন। বেসামরিক লোকজন মিলিয়ে ইরানে গত পাঁচ দিনে প্রাণহানি বেড়ে ৪৫২ জন হয়েছে। ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরায়েলে নিহতের সংখ্যা বেড়ে গতকাল বিকেলে ২৪ জনে দাঁড়িয়েছে।

সমাধানে দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই: ইরানে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে ২০টি আরব ও মুসলিম দেশ। মিসরের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা মেনা জানিয়েছে, যৌথ বিবৃতি দেওয়া দেশগুলো হলো মিসর, জর্ডান, পাকিস্তান, বাহরাইন, ব্রুনেই, তুরস্ক, চাদ, আলজেরিয়া, কমোরস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জিবুতি, সৌদি আরব, সুদান, সোমালিয়া, ইরাক, ওমান, কাতার, কুয়েত, লিবিয়া ও মৌরিতানিয়া। বিবৃতিতে দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে বিপজ্জনকভাবে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় তাঁরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তাঁরা কূটনৈতিক তৎপরতায় সমস্যা সমাধানে তাগিদ দিয়েছেন।

কানাডায় চলমান শিল্পোন্নত সাত দেশের জোট জি৭ সম্মেলনেও আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল ইরান-ইসরায়েল সংঘাত। কিন্তু সেখান থেকেও শুধু একটি গতানুগতিক যৌথ বিবৃতি এসেছে, যাতে নেতারা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য তাঁদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সম্মেলনের ফাঁকে এক বৈঠকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খোঁজার প্রয়োজনীয়তায় গুরুত্বারোপ করেছেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ কূটনীতিক কাজা কালাস জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে এক অনলাইন বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, সংঘাত থামানো না গেলে তা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে। কাজাখস্তানে উজবেকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শাফকাত মিরজিয়োয়েভের সঙ্গে এক বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছেন, ইসরায়েলের কারণে হঠাৎ করেই মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বেড়ে গেছে। চীন বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

কাতার বলেছে, তারা ইরান-ইসরায়েল সংঘাত বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিদিনই যোগাযোগ করছে। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল আনসারি এ তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘আমরা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সব পক্ষের সঙ্গে সম্ভাব্য সব উপায়ে যোগাযোগ করছি।’ তিনি বলেন, দোহা আপাতত ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনা শুরুর পথ খুঁজতে যোগাযোগ করছে। তবে কোনো পক্ষই এ পর্যন্ত আলোচনা শুরুর জন্য কোনো শর্তের কথা জানায়নি। জর্ডানের রাজা আবদুল্লাহ ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে দেওয়া এক বক্তব্যে বলেছেন, ইসরায়েল তার আগ্রাসন ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত করেছে। এই সংঘাত বাড়তে বাড়তে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউই বলতে পারছে না। এই সংঘাত বন্ধ হতে হবে। এদিকে পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এক ফোনকলে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি বলেছেন, ইরান পুরো মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে দিচ্ছে।

‘যুদ্ধবিরতির বেশি’ চান ট্রাম্প : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জি৭ সম্মেলন ছেড়ে আগেভাগেই ওয়াশিংটনের পথে রওনা হন। কানাডা থেকে এয়ারফোর্স ওয়ান বিমানে ওঠার কিছু পরই তিনি সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের বলেন, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি নয়, তিনি আরও বেশি কিছু চান। তাঁর ভাষ্যমতে, ‘যুদ্ধবিরতির চেয়েও ভালো কিছু চাই আমি।’ তাঁর এ কথার অর্থ স্পষ্ট নয় বলে বিবিসির উত্তর আমেরিকা প্রতিবেদক মন্তব্য করেছেন। একই সঙ্গে ইসরায়েল ইরানে হামলা জোরদার করবে বলে ইঙ্গিত দিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘আপনারা দুই দিনের মধ্যে তা দেখতে পারবেন। এ পর্যন্ত কেউই তো হামলার মাত্রা কমায়নি।’ এ সময় ট্রাম্প আবার হুঁশিয়ারি দেন, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্বার্থে আঘাত হানলে ইরানকে তার কঠোর জবাব দেওয়া হবে। এর আগে নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ স্যোশালে এক পোস্টে ট্রাম্প বলেন, তিনি ইরানের সঙ্গে শান্তি আলোচনার জন্য কোনো ধরনের যোগাযোগ করেননি। তিনি বলেন, ‘তারা (ইরানি কর্তৃপক্ষ) যদি আলোচনায় বসতে চায়, আমার সঙ্গে যোগাযোগের পথ তাদের জানা আছে। তারা যদি চুক্তি করত, তাহলে অনেক জীবন বেঁচে যেত।’

আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের যোগাযোগ : ইসরায়েলের হামলা থামাতে যুক্তরাষ্ট্র যেন চাপ সৃষ্টি করে, সে জন্য কাতার, সৌদি আরব ও ওমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে তেহরান। দুই ইরানি ও তিন আঞ্চলিক সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে।

আলোচনায় খামেনিকে হত্যার পরিকল্পনা : ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে হত্যায় ইসরায়েলি পরিকল্পনা সম্পর্কে অতিসম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে সেসব প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, ট্রাম্পের সমর্থন না পাওয়ায় সেই পরিকল্পনা থেকে পিছু হটেছে ইসরায়েল। তবে দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গত সোমবার ফের আভাস দিয়েছেন, হত্যার সেই পরিকল্পনা এখনো তাঁর বিবেচনায় রয়েছে। এমনকি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ গতকাল দেশের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক বৈঠকে বলেছেন, ইরান যদি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং যুদ্ধাপরাধ অব্যাহত রাখে, তাহলে তাদের স্বৈরশাসককে (খামেনি) ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের মতো পরিণতি বরণ করতে হবে।

থেমে নেই পাল্টাপাল্টি হামলা : গতকাল সংঘাতের পঞ্চম দিনেও ইরান ও ইসরায়েল পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে। যদিও এ দিন ইরানের তরফ থেকে পাল্টা হামলার তীব্রতা কম ছিল। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী বলেছে, ইরান তাদের লক্ষ্য করে ৩০টির মতো ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। ইরান দাবি করেছে, তারা তেল আবিবে দেশটির গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের সদর দপ্তরসহ সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। অপর দিকে ইসরায়েলের দাবি, তাদের অভিযানে ইরানের যুদ্ধকালীন সামরিক প্রধান আলী শাদমানি নিহত হয়েছেন। পাল্টাপাল্টি এই হামলার মধ্যেই গতকাল ইরানি ব্যাংক সেপাহ সাইবার হামলার শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা ফার্স। ইরানের পেট্রল পাম্পগুলোয় লেনদেনের জন্য এই ব্যাংকটি ব্যবহার হয়। ইসরায়েলসংশ্লিষ্ট একটি হ্যাকার গোষ্ঠী সাইবার হামলার দায় স্বীকার করেছে। এদিকে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে চারজন হয়েছে।

নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার হিড়িক : সংঘাতের জেরে ইরান ও ইসরায়েল থেকে নিজেদের নাগরিকদের সরিয়ে নিচ্ছে বিভিন্ন দেশ। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল, পশ্চিম তীর ও গাজায় অবস্থানরত তার সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। ইরানে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকদেরও একই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছে, ইরানে অবস্থানরত দেশটির প্রায় ৬৫০ জন নাগরিক দেশে ফিরতে আবেদন করেছেন। ইসরায়েল থেকেও প্রায় ৬০০ অস্ট্রেলীয় সরে যেতে আবেদন করেছেন। ভারত এরই মধ্যে তেহরানে অবস্থানরত তাদের কিছু শিক্ষার্থীকে সরিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানও ইরান থেকে কয়েক শ শিক্ষার্থীকে বের করে এনেছে। থাইল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশ দেশ দুটি থেকে নাগরিকদের সরানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এদিকে ৬০০ জনের বেশি বিদেশি নাগরিক ইরান ছেড়ে পাশের দেশ আজারবাইজানে আশ্রয় নিয়েছেন।