২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

সিলেট-৫ ত্রিমুখী সংকটে জমিয়ত, এগিয়ে ৮ দলের সম্ভাব্য প্রার্থী

সিলেট-৫ (কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ) আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। বিএনপির সঙ্গে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের জোট হওয়ায় দলটির কেন্দ্রীয় সভাপতি উবায়দুল্লাহ ফারুককে আসনটি আনুষ্ঠানিকভাবে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

এমন অবস্থায় ‘অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ’ বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী মামুনুর রশীদ (চাকসু মামুন)। গত ২৪ ডিসেম্বর তিনিও মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। প্রকাশ্যে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে নির্বাচনী তৎপরতা চালাচ্ছে। উপজেলা বিএনপির অনেক নেতা মামুনুর রশীদের সাথে রয়েছেন।

যেহেতু কেন্দ্রীয় হাই কমান্ড জোট শরিক জমিয়তকে আসনটি ছেড়ে দিয়েছে, তাই অনেকে প্রকাশ্যে এখনো কারও পক্ষ নিচ্ছেন না। তবে বিএনপির মহাসচিব দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হবেন, তাদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। গুঞ্জন আছে, বিএনপির হাইকমান্ডের সিদ্ধান্ত অমান্য করে হলেও চাকসু মামুন এই আসনে প্রার্থী হচ্ছেন এবং ‘বিদ্রোহ’ করে হলেও নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চান তিনি।

সর্বশেষ ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আসনটিতে ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন। ওই একবারই এখানে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হন। এরপর ২০০১ সাল থেকে জোট রাজনীতির অংশ হিসেবে বিএনপি আসনটিতে প্রতিবার ইসলামপন্থী দলের নেতাদের প্রার্থী করেছে। ২০০১ ও ২০০৮ সালে বিএনপির জোটসঙ্গী হিসেবে আসনটিতে জামায়াত নেতা ফরীদ উদ্দিন চৌধুরী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তিনি ২০০১ সালে বিজয়ী হন।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির জোটসঙ্গী হিসেবে মনোনয়ন পেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের বর্তমান কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক। সেবার মামুনুর রশিদ (চাকসু মামুন) বিএনপির প্রাথমিক মনোনয়ন পেলেও জোট রাজনীতির ভাগ-বাঁটোয়ারার অংশ হিসেবে শেষ পর্যন্ত উবায়দুল্লাহ ফারুক চূড়ান্ত মনোনয়ন পান।

স্থানীয় লোকজন বলছেন, এ আসনে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর ‘ভোটব্যাংক’ আছে। এটা বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন ইসলামপন্থী দল বিগত একাধিক নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীর বদলে ‘জোট রাজনীতির’ অংশ হিসেবে আসনটিতে নিজেদের প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। তবে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীর দাবি, আসনটিতে ইসলামপন্থী দলগুলো বিভাজিত থাকায় পৃথকভাবে সেই অর্থে কারও ভোটব্যাংক নেই। এখানে বিএনপির ভোটারই বেশি। তাছাড়া এবার যেহেতু বিএনপির ধানের শীষ প্রতীকে শরিক দলের কেউ নির্বাচন করতে পারবেন না, তাই জমিয়তের খেজুর গাছ প্রতীকের পক্ষে বিএনপি সমর্থকরা কতটা সাড়া দেন, সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

স্বাধীনতার পর আসনটিতে চারবার আওয়ামী লীগ, তিনবার জাতীয় পার্টি ও দুবার স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয়ী হন। এ ছাড়া বিএনপি, ইসলামী ঐক্যজোট ও জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থীরা একবার করে জয়ী হয়েছেন। সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (যেটাকে ডামি নির্বাচন বলা হয়) ফুলতলীর পীর হুছামুদ্দীন চৌধুরী কেটলী প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন।

বিএনপি জোটের প্রার্থী জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক ২০১৮ সালের নির্বাচনেও অংশ নিয়েছিলেন। তবে সেবার তিনি ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন। এবার যেহেতু জমিয়তের দলীয় প্রতীকে খেজুরগাছে নির্বাচন করবেন, তাই বিএনপির অনেক নেতাকর্মী এতে কিছুটা বিব্রতও।

অপরদিকে জমিয়তও আছে বেশ চাপে। কারণ, একসময় বিএনপি-জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ থাকায় জমিয়তেরই একাংশ মাওলানা আলীমুদ্দিন দুর্লভপুরীর নেতৃত্বে ‘জমিয়তে উলামা বাংলাদেশ’ নামে অরাজনৈতিক আরেকটি দল করেন। তাঁরা নারীনেতৃত্ব ও জামায়াতবিরোধিতার কারণে অনেকটা ‘আওয়ামী লীগ ঘেঁষা’ ছিলেন। পরে ২০২১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকে জমিয়তে বেরিয়ে এলে জমিয়তের উলামার সাথে আদর্শিক যে দ্বন্দ্ব ছিল, সেটা অনেকটাই দূর হয়ে যায়। এরপর এককাট্টা হয়ে যুগপথ আন্দোলন করেছে দল দুটি। এমনকি জমিয়তে উলামার কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতা জমিয়তের উলামায়ে ইসলামের সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্থান পান। জমিয়তে উলামার কেন্দ্রীয় দফতর কানাইঘাটে উবায়দুল্লাহ ফারুকসহ জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতারা গণ গণ যাতায়াত করেন।

একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত হয়, আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জমিয়তে উলামা নীতিগতভাবে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে কাজ করবে। এজন্য উভয় জমিয়ত সিলেট-৫ আসনে ঐক্যবদ্ধভাবে মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুকের সাথে কাজ করবে। বিনিময়ে সিলেট-৪ (গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানিগঞ্জ) আসনে জমিয়তে উলামার কেন্দ্রীয় নেতা এড. মোহাম্মদ আলীকে সমর্থন দেবে।

সিলেট-৪ আসনে এড. মোহাম্মদ আলী নির্বাচনী তৎপরতা চালান। তবে জোট থেকে আসনটি আদায়ের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালেও শেষ পর্যন্ত কোনো লাভ হয়নি। বিএনপির সাথে জমিয়তের জোটকেন্দ্রিক নির্বাচন এতদিন শুধু এই এক আসনের কারণে বিলম্ব হচ্ছিল। সবশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর জমিয়ত মাত্র চারটি আসন নিয়ে বিএনপির সাথে সমঝোতায় পৌঁছে। আসন চারটি হলো, সিলেট-৫ আসনে জমিয়তের সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক, নীলফামারী-১ আসনে মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে মুফতি মনির হোসাইন কাসেমী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিবকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

এদিকে জমিয়ত ছাড়া বাকি ইসলামি দলগুলো এবার আসন সমঝোতার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, দুই খেলাফত মজলিসসহ অন্যান্য দলগুলো মিলিয়ে এখানে প্রার্থী একজন থাকবেন। আর এটা নিশ্চিত, কোনো আলেমই হবেন এখানকার প্রার্থী। এতে ইসলামপন্থীদের ভোট ভাগ হয়ে যাবে। সেখানে চাকসু মামুন বিএনপির ভোট টানলে মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুকের জন্য পেরে ওঠা কঠিন হতে পারে।

বিএনপি আপাতত বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে নীরব থাকলেও ভোটের সময় ঘনিয়ে এলে তাদের সরিয়ে ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। বিশেষ করে জমিয়ত এবার আরও কয়েকটি আসন চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চারটি আসনেই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের আশ্বস্ত করা হয়, বিদ্রোহী কোনো প্রার্থী থাকবে না। সেটার জন্য তারা সব চেষ্টা করবে। এক্ষেত্রে বিএনপির হাইকমান্ডের হস্তক্ষেপে চাকসু মামুন শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠ থেকে সরে দাঁড়াতে পারেন বলেও গুঞ্জন আছে।

অন্যদিকে জামায়াত নেতৃত্বাধীন আট দল এখনো আসন সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলেও বসে নেই সম্ভাব্য প্রার্থীরা। সিলেট-৫ আসনে জামায়াত দলীয় প্রার্থী হচ্ছেন জেলার নায়েবে আমির হাফিজ আনোয়ার হোসেন খান, খেলাফত মজলিসের সিলেট জেলার উপদেষ্টা মাওলানা আবুল হাসান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা রেজাউল করিম আবরার ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের রেজাউল করিম জালালী প্রার্থী হিসেবে কাজ করছেন।

তবে আট দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে মূল লড়াই চলছে মূলত জামায়াত ও খেলাফত মজলিসের প্রার্থীর মধ্যে। আট দলীয় জোট যদি শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে, তাহলে জামায়াতের হাফিজ আনোয়ার হোসেন খান ও খেলাফত জলিসের মাওলানা আবুল হাসান থেকে যেকোনো একজন মনোনয়ন পাবেন। তবে মাঠ জরিপে এই আসনে খেলাফত মজলিসের প্রার্থী সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন।

সিলেট-৫ আসন কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত। এই আসনে মোট ভোটার রয়েছেন ৪ লাখ ৯ হাজার ৯৫৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১১ হাজার ৬৬৭ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৯৮ হাজার ২৮৯ জন। এর মধ্যে কানাইঘাট উপজেলায় ভোটার রয়েছেন ২১০,৭০৪ জন, আর জকিগঞ্জ উপজেলায় ১৯০, ২৫২ জন। তবে উপজেলার ভোটাররা হয়তো ভাগ হয়ে যাবেন। যেহেতু কানাইঘাট উপজেলা থেকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকবেন মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক ও বিএনপির বিদ্রোহী চাকসু মামুন, তাই এই উপজেলার ভোট দুজনের ভাগেই যাবে। অপরদিকে আট দল থেকে যদি মাওলানা আবুল হাসান মনোনয়ন পান, তবে জকিগঞ্জ উপজেলা থেকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা প্রার্থী একমাত্র তিনিই। তাছাড়া তাঁর ব্যক্তি ইমেজও ভালো। ফুলতলী ধারার অনেক ভোটও তিনি পারেন। এর বাইরে তাঁর নিজস্ব কিছু ভোটব্যাংকও রয়েছে।

ধারণা করা হচ্ছে, জকিগঞ্জে তিনি একচেটিয়া ভোট পাবেন। আর কানাইঘাট থেকেও উল্লেখযোগ্য ভোট পাবেন। সব মিলিয়ে মাওলানা আবুল হাসানের জন্য নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া অনেকটা সহজ। তবে শেষ পর্যন্ত যদি বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী চাকসু মামুন তাঁর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন, তখন বিএনপি জোট ও আট দলীয় জোটের লড়ােই হবে শেয়ানে শেয়ানে। মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক তখন অনেকটা এগিয়ে থাকবেন। আর যদি আট দল থেকে জামায়াতের হাফিজ আনওয়া মনোনয়ন পান, চাকসু মামুনও মাঠে থাকেন, তবে লড়াই হবে ত্রিমুখী। তখন তিন জনের যে কেউ পাশ করার সম্ভাবনা রয়েছে।

গুঞ্জন আছে, জমিয়তের ভেতরে মাওলানা আলীমুদ্দিন দুর্লভপুরীর জমিয়তের যে সমঝোতা হয়েছে, তাতে অনেকটা হতাশ জমিয়তে উলামার নেতাকর্মীরা। তাঁদের কাঙ্ক্ষিত সিলেট-৪ আসন না পাওয়ায় ভেতরে ভেতরে তাঁরা ক্ষোভে ফুঁসছেন। নির্বাচনের দিন তাঁদের সিদ্ধান্ত ভিন্ন কিছু হলেও আশ্চর্যের কিছু থাকবে না।
সিলেট-৫ আসনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামি, জমিয়তে ইসলাম, খেলাফত মজলিস এবং একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের তথ্য অনুযায়ী এই মনোনয়নপত্রগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সংগ্রহ করেছেন।

নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯ ডিসেম্বর। ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র বাছাই করা হবে। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর আগামী ৫ জানুয়ারি থেকে ৯ জানুয়ারি আপিল করতে পারবেন প্রার্থীরা। এবং এই আপিল নিষ্পত্তি করা হবে আগামী ১০ জানুয়ারি থেকে ১৮ জানুয়ারির মধ্যে।

এদিকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২০ জানুয়ারি। রিটার্নিং কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে প্রতীক বরাদ্দ করবেন ২১ জানুয়ারি। নির্বাচনি প্রচারণা শুরু হবে ২২ জানুয়ারি। প্রচার চালানো যাবে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। আর ভোটগ্রহণ করা হবে ১২ ফেব্রুয়ারি।