প্রিয় বাংলাদেশ—শুরু করলেন ঠিক এভাবেই। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে লাখ লাখ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বললেন, ‘উই হ্যাভ আ প্ল্যান। উই হ্যাভ আ প্ল্যান ফর দ্য পিপল, ফর দ্য কান্ট্রি।’
দেশের মানুষের জন্য, দেশের জন্য নেওয়া সেই প্ল্যান (পরিকল্পনা) বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা দরকার—এ কথাও স্পষ্ট করেই বলেছেন তারেক রহমান। দেশের মাটিতে পা রেখে প্রথম যে বক্তব্য দিলেন, সেখানে সেই পরিকল্পনার বিস্তারিত অবশ্য উল্লেখ করেননি তিনি। শুধু বলেছেন, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য যদি সেই প্ল্যান (পরিকল্পনা) বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে প্রত্যেক মানুষের সহযোগিতা তাঁর লাগবে।
বক্তব্যের শুরুর দিকে ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’ বললেও পরে অবশ্য ‘উই হ্যাভ আ প্ল্যান’ বলেছেন তারেক রহমান।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কে তারেক রহমানকে স্বাগত জানাতে গণসংবর্ধনার আয়োজন করে বিএনপি। জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়ে নামের ওই সড়কে নির্মিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রায় ১৬ মিনিট বক্তব্য দেন তিনি। বিএনপির এই শীর্ষ নেতাকে স্বাগত জানাতে সারা দেশ থেকে লাখ লাখ নেতা-কর্মী ৩০০ ফুট সড়কে জড়ো হন। তারেক রহমানের বক্তব্যের আগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন। তাঁরা তারেক রহমানকে স্বাগত জানান।
দলের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, ‘মার্টিন লুথার কিংয়ের নাম তো শুনেছেন না আপনারা? তাঁর একটি বিখ্যাত ডায়ালগ আছে, আই হ্যাভ আ ড্রিম। আজ এই বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আপনাদের সকলের সামনে আমি বলতে চাই, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের একজন সদস্য হিসেবে আপনাদের সামনে আমি বলতে চাই, আই হ্যাভ আ প্ল্যান, পিপল অব মাই কান্ট্রি, ফর মাই কান্ট্রি। আজ এই পরিকল্পনা দেশের মানুষের স্বার্থে।’
সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা চেয়ে তারেক রহমান বলেন, দেশের উন্নয়নের জন্য, দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য যদি সেই প্ল্যান, সেই কার্যক্রম, সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে হয়, তাহলে প্রত্যেক মানুষের সহযোগিতা লাগবে। যদি সবাই পাশে থাকে, সহযোগিতা করে তাহলে ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করা সক্ষম হবে।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ছিলেন আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা, যিনি বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমেরিকায় যখন বর্ণবৈষম্য চরম পর্যায়ে পৌঁছায় এবং কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর দমন-পীড়ন চলতে থাকে, তখন অধিকারহীন মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠেন তিনি। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশাল সমাবেশে ঐতিহাসিক ভাষণে মানুষের সম–অধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে নিজের স্বপ্নের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’। তাঁর ওই ভাষণ বিশ্বজুড়ে মুক্তিকামী মানুষের চেতনাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
প্রায় ১৬ মিনিটের বক্তব্য শেষে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানান তারেক রহমান। তখন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানা হচ্ছিল। ঠিক ওই সময় আবার মাইকের সামনে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মনে রাখবেন, উই হ্যাভ আ প্ল্যান। উই হ্যাভ আ প্ল্যান ফর দ্য পিপল, ফর দ্য কান্ট্রি। ইনশা আল্লাহ, আমরা সেই প্ল্যান বাস্তবায়ন করব।’
তারেক রহমান মঞ্চে ওঠেন গতকাল বেলা ৩টা ৫১ মিনিটে। বক্তব্য শুরু করেন বেলা ৩টা ৫৭ মিনিটে। এর আগে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দুপুর সাড়ে ১২টার কিছু সময় পর তিনি বাসে করে পূ্র্বাচলের সংবর্ধনাস্থলের উদ্দেশে যাত্রা করেন। পুরো পথ ছিল লোকে লোকারণ্য। যে কারণে পূর্বাচলের মঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছাতে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়।
বক্তব্যে মানুষের নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার কথা একাধিকবার বলেছেন তারেক রহমান। ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশানির্বিশেষে দেশের সব মানুষ যাতে নিরাপদে থাকতে পারে, সেই প্রত্যাশার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা যে ধর্মের মানুষ হই, আমরা যে শ্রেণির মানুষ হই, আমরা যে রাজনৈতিক দলের সদস্য হই অথবা একজন নির্দলীয় ব্যক্তি হই, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে—যেকোনো মূল্যে আমাদের এই দেশের শান্তিশৃঙ্খলাকে ধরে রাখতে হবে। যেকোনো মূল্যে যেকোনো বিশৃঙ্খলাকে পরিত্যাগ করতে হবে। যেকোনো মূল্যে আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যাতে মানুষ নিরাপদ থাকতে পারে। শিশু হোক, নারী হোক, পুরুষ হোক—যেকোনো বয়স, যেকোনো শ্রেণি, যেকোনো পেশা, যেকোনো ধর্মের মানুষ যেন নিরাপদ থাকে—এই হোক আমাদের চাওয়া।’
বক্তব্যে বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, ১৯৭১ সালে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে এই দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে দেশ রক্ষা করা হয়েছিল এবং ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এ দেশের জনগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ছিনিয়ে এনেছিল। তবে ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি।
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র–জনতাসহ সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল বলে উল্লেখ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, কৃষক-শ্রমিক, গৃহবধূ, নারী-পুরুষ, মাদ্রাসার ছাত্রসহ দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষ ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট এই দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে রক্ষা করেছিল। তরুণ প্রজন্মের সদস্যরা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে।
এ প্রসঙ্গে তারেক রহমান আরও বলেন, কয়েক দিন আগে ’২৪-এর আন্দোলনের এক সাহসী সদস্য ওসমান হাদিকে হত্যা করা হয়েছে। ওসমান হাদি শহীদ হয়েছেন। ওসমান হাদি চেয়েছিলেন এই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হোক, মানুষের গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ফিরে আসুক। রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।
বিভিন্ন আধিপত্যবাদী শক্তির গুপ্তচরেরা বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্রে এখন লিপ্ত রয়েছে উল্লেখ করে তারেক রহমান বলেন, এই পরিস্থিতিতে ধৈর্যশীল হওয়া জরুরি এবং তরুণ প্রজন্মকে দায়িত্ব নিতে হবে। তরুণেরাই আগামী দিনে দেশকে নেতৃত্ব দেবে এবং শক্ত গণতান্ত্রিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দেশ গড়বে।
একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের প্রত্যাশা তুলে ধরে তারেক রহমান বলেন, এই দেশে পাহাড়ের মানুষ আছে, সমতলের মানুষ আছে, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করে। তিনি বলেন, এমন দেশ গড়তে চান যে দেশে একজন নারী, একজন পুরুষ, একজন শিশু—যেই হোক না কেন, নিরাপদে ঘর থেকে বের হলে নিরাপদে যেন আবার ঘরে ফিরে আসতে পারে।
তারেক রহমান বলেন, দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, চার কোটির বেশি তরুণ প্রজন্মের সদস্য, পাঁচ কোটির মতো শিশু, ৪০ লাখের মতো প্রতিবন্ধী মানুষ এবং কয়েক কোটি কৃষক-শ্রমিক রয়েছেন। এই মানুষগুলোর প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষা আছে রাষ্ট্রের কাছে। সবাই ঐক্যবদ্ধ হলে এই প্রত্যাশাগুলো পূরণ করা সম্ভব।
তারেক রহমান বলেন, মানুষ কথা বলার অধিকার ফিরে পেতে চায়, গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পেতে চায়। তারা চায় যোগ্যতা অনুযায়ী, ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত হোক। তিনি বলেন, এই দেশে পাহাড়ের মানুষ আছে, সমতলের মানুষ আছে; মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান—সব ধর্মের মানুষ বসবাস করে। সবাইকে নিয়েই বাংলাদেশ।
যেকোনো মূল্যে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, যেকোনো উসকানির মুখে ধীর-শান্ত থাকতে হবে। বিশৃঙ্খলাকে পরিহার করে ধৈর্যের সঙ্গে তা মোকাবিলা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, ধৈর্যশীল হতে হবে। ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে দেশ পরিচালনার বিষয়ে তারেক রহমান বলেন, ‘আসুন, আমরা সকলে মিলে প্রতিজ্ঞা করি যে, ইনশা আল্লাহ আগামী দিনে দেশ পরিচালনার দায়িত্বে যারা আসবে আমরা সকলে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যে ন্যায়পরায়ণতা, সেই ন্যায়পরায়ণতার আলোকে আমরা দেশ পরিচালনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।’
দেশে ফেরার আগে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেওয়া ভার্চ্যুয়াল বক্তব্যে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বললেও গতকাল এ নিয়ে কিছু বলেননি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, সন্তান হিসেবে তাঁর মন হাসপাতালে মায়ের শয্যার পাশে পড়ে আছে, তবে যাঁদের জন্য খালেদা জিয়া নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন—দেশের সেই মানুষদের তিনি কোনোভাবেই ফেলে যেতে পারেন না।
সংবর্ধনা মঞ্চের প্রথম সারিতে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ, হাফিজ উদ্দিন আহমদ, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রমুখ। সঞ্চালক ছিলেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী (এ্যানি)। এর আগে মঞ্চ থেকে বিভিন্ন ঘোষণা ও স্লোগান দেন বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন (টুকু)।
এ ছাড়া বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করা শরিক ও সমমনা দলগুলোর নেতাদের মধ্যে ছিলেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তানিয়া রব, সদ্য বিএনপিতে যোগ দেওয়া এলডিপির সাবেক মহাসচিব রেদোয়ান আহমদ, গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব গোলাম মহিউদ্দিন ইকরাম, এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, এনডিএমের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ ও আমজনতার দলের সাধারণ সম্পাদক তারেক রহমান। – প্রআ