১৯৮১ সালে স্বামী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর এক কঠিন পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া এই মহীয়সী নেত্রী গত মে মাসে দলের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালনের ৪১ বছর পূর্ণ করেছিলেন। তার এই সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি কেবল একটি দলকে সুসংগঠিত করেননি, বরং তিনবার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন।
বিএনপির দাপ্তরিক তথ্যানুযায়ী, ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বেগম খালেদা জিয়া দলের প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন। সাংগঠনিক দক্ষতায় মাত্র এক বছরের মাথায় ১৯৮৩ সালের মার্চে তিনি দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান। এরপর ১৯৮৪ সালের ১২ জানুয়ারি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন এবং একই বছরের ১০ মে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।
আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বেগম খালেদা জিয়ার অর্জন ছিল ঈর্ষণীয়। ১৯৯১ সালে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিশেষ করে নারী শিক্ষা ও নারী ক্ষমতায়নে তার প্রগতিশীল ভূমিকা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছে।
এর স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালে বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিনের করা বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় তিনি ২৯তম অবস্থানে ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, এরশাদ ও শেখ হাসিনা—এই দুই শাসকের বিরুদ্ধে আড়াই দশকব্যাপী দীর্ঘ লড়াই খালেদা জিয়াকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল যে, দক্ষিণ এশিয়াসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তার মতো নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে অগ্নিপরীক্ষা শুরু হয় বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। ওই সময়ে দুটি বিতর্কিত মামলায় কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে তাকে দুই বছরেরও বেশি সময় কারাভোগ করতে হয়।
২০২০ সালে করোনা মহামারির শুরুতে এক নির্বাহী আদেশে তার সাজা স্থগিত করে গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’য় শর্ত সাপেক্ষে থাকার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরদিন তিনি সম্পূর্ণভাবে মুক্তি পান।
এরপর ২০২৫ সালের ৭ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান এবং ১১৭ দিন চিকিৎসা শেষে ৬ মে দেশে ফেরেন। তবে দেশে ফেরার পর থেকেই তিনি বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিল শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আজ ভোর ৬টায় তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির এক মহাকাব্যিক অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল।

