সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ) আসনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি, জামায়াত, খেলাফত মজলিস, এনসিপি, স্বতন্ত্রসহ বেশ কয়েকটি দলের একডজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আগ্রহী।
সম্ভাব্য এসব প্রার্থীরা তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে নির্বাচনী এলাকায় জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায় প্রতিদিনই তাঁদের পক্ষে কর্মী-সমর্থকেরা নানা ধরনের অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশ আয়োজনের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন।
ইতিমধ্যে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জাতীয় পার্টি (জিএম কাদের) আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে। স্বতন্ত্রসহ অনেক প্রার্থী ইতিমধ্যে মনোনয়ন ফরমও সংগ্রহ করেছেন।
এই আসনে বিএনপি জোট থেকে তাদের শরীক দলের তেমন শক্ত অবস্থান না থাকায় এখানে বিএনপি দলীয় প্রার্থীই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, এটা প্রায় নিশ্চিত।
তবে জামায়াতসহ আট দলীয় জোট এই আসনে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো প্রার্থী ঘোষণা দেয়নি। ফলে কে হচ্ছেন বিএনপি দলীয় প্রার্থী যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালিকের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী, এই প্রশ্ন এখন সাধারণ ভোটারদের মনে ঘোরপাক খাচ্ছে।
সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ) আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যারিস্টার এম এ সালাম ও যুক্তরাজ্য বিএনপির সভাপতি এম এ মালেক। তবে শেষ পর্যন্ত দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন এম এ মালেক। যদিও যুক্তরাজ্য প্রবাসী ব্যারিস্টার এম এ সালাম এখনো হাল ছাড়েননি; মনোনয়ন ফরমও সংগ্রহ করেছেন।
বিএনপি ছাড়া এই আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা লোকমান আহমদ। সিলেটের যেসব আসনে জামায়াতের শক্ত অবস্থান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম এটি। দক্ষিণ সুরমা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাওলানা লোকমান দীর্ঘদিন থেকে এলাকায় কাজ করছেন। এছাড়া এই আসনের আরেক শক্ত প্রার্থী হলেন সিলেট জেলা খেলাফত মজলিসের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা দিলওয়ার হুসাইন। তিনিও দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচনী এলাকায় কাজ করে যাচ্ছেন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
এ ছাড়া এনসিপির শপালাকলি প্রতীকে তরুণ তুর্কী ব্যারিস্টার নূরুল হুদা জুনেদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী প্রিন্সিপাল মাওলানা রেদওয়ানুল হক চৌধুরী রাজু, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশে মনোনিত প্রার্থী মাওলানা নজরুল ইসলাম, স্বতন্ত্র প্রার্থী মইনুল বাকরও নিয়মিত গণসংযোগ করছেন।
এই আসনে বিএনপির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করা হচ্ছে আট দলীয় জোটের প্রার্থীকে। তবে জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোট এই আসনে প্রার্থী বাছাইয়ে মধুর বিড়ম্বনায় পড়েছে। এতদিন শুধু জামায়াত আর খেলাফত মজলিস থেকে যেকোনো একটি দলের প্রার্থীই এই আসনে মনোনয়ন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে সাধারণ ভোটারদের আগ্রহ ছিল।
এতদিন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস থেকে সংগঠনের সিলেট জেলা শাখার সিনিয়র সহ-সভাপতি ও গহরপুর মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম হাজীপুরীকে সিলেট-৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছিল। তিনি ২০১৮ সালেও রিক্সা প্রতীকে নির্বাচন করেছিলেন।
গত ৬ ডিসেম্বর শনিবার দুপুরে বালাগঞ্জে উলামা-সুধী সমাবেশে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক তাঁর দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী হিসেবে গহরপুর মাদরাসার মুহতামিম, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সহ-সভাপতি ও সাবেক ছাত্রনেতা হাফিজ মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজুর নাম ঘোষণা করেন।
এরপরই সিলেট-৩ আসনে নির্বাচনী নতুন করে ভিন্ন মোড় নিতে থাকে। আট দলীয় জোটের সম্ভাব্য অপর দুই প্রার্থীর সাথে নতুন করে আলোচনায় উঠে আসেন মাওলানা রাজু। জোটগত সিদ্ধান্তেও শুরু হয়েছে জটিলতা। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস সিলেটের ছয়টি আসনের মধ্যে সিলেট-৩ আসনটি যেকোনোভাবে পেতে চায়।
অন্যদিকে খেলাফত মজলিস ও জামায়াতের প্রার্থীও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান। এমতাবস্থায় এই আসনের সাধারণ ভোটারদের মধ্যে মনে জল্পনা শুরু হয়েছে, কে হচ্ছেন ইসলামি ধারার প্রার্থী।
গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে, সিলেটের ছয়টি আসনের মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ৩টি, খেলাফত মজলিস ২টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ১টি আসন পাবে। এর মধ্যে সিলেট-১ আসনে জামায়াতের মাওলানা হাবীবুর রহমান, সিলেট-২ আসনে খেলাফত মজলিসের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মুনতাসির আলী, সিলেট-৩ আসনে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু, সিলেট-৪ আসনে জামায়াতের মো. জয়নাল আবেদীন, সিলেট-৫ আসনে খেলাফত মজলিসের মাওলানা আবুল হাসান, সিলেট-৬ আসনে জামায়াতের মো. সেলিম উদ্দীন।
তবে খেলাফত মজলিস ৩টি আসন পেতে চাইছে। এর মধ্যে সিলেট-২, সিলেট-৩ ও সিলেট-৫ আসন। যদি শেষ মুহূর্তে মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু মাওলানা মামুনুল হকের দলে যোগ দেওয়ায় সব হিসাবনিকাশ পাল্টে গেছে। তারা যেকোনোভাবে এই আসন পেতে চাইছে।
এদিকে খেলাফত মজলিস এবং জামায়াতে ইসলামীও অনড়, তারা দীর্ঘদিন ধরে মাঠপর্যায়ে কাজ করে যাচ্ছেন। যদিও শেষ পর্যন্ত কে হবেন এই আসনে আট দলের প্রার্থী, সেটা হয়তো দু-তিন দিনের মধ্যেই জানা যাবে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসের তথ্য অনুযায়ী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সংগ্রহ করেছেন। তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের ছয়টি আসনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯টি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন সিলেট-৩ আসনের প্রার্থীরা।
গত ২৪ ডিসেম্বর বুধবার এই আসনে খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মাওলানা দিলওয়ার হোসাইন, স্বতন্ত্র প্রার্থী মইনুল বাকর মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। পরদিন ২৫ ডিসেম্বর জাতীয় নাগরিক পার্টির প্রার্থী ব্যারিস্টার নূরুল হুদা জুনেদ, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা লোকমান আহমদ, বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ আব্দুল মালেক, বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ব্যরিস্টার মো. আবুস সালাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী প্রিন্সিপাল মাওলানা রেদওয়ানুল হক চৌধুরী রাজু, জাতীয় পার্টি (জিএম কাদের)-এর প্রেসিডিয়াম সদস্য আতিকুর রহমান আতিক ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোস্তাকিম রাজা চৌধুরী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন।
সব শেষ আজ শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) মাওলানা মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রার্থী মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজুর পক্ষে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা হয়।
খসড়া ভোটার তালিকা অনুযায়ী সিলেট-৩ আসনে (দক্ষিণ সুরমা, ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ) বর্তমানে মোট ভোটার রয়েছেন ৪ লাখ ২৯ হাজার ৭৭৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৫ হাজার ৮৩৪ জন, নারী ভোটার ১ লাখ ৯৮ হাজার ৫১৩ জন এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন ১ জন।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯ ডিসেম্বর। ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৪ জানুয়ারি ২০২৬ পর্যন্ত মনোনয়নপত্র বাছাই করা হবে। মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ের পর আগামী ৫ জানুয়ারি থেকে ৯ জানুয়ারি আপিল করতে পারবেন প্রার্থীরা। এবং এই আপিল নিষ্পত্তি করা হবে আগামী ১০ জানুয়ারি থেকে ১৮ জানুয়ারির মধ্যে।
এদিকে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ২০ জানুয়ারি। রিটার্নিং কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে প্রতীক বরাদ্দ করবেন ২১ জানুয়ারি। নির্বাচনি প্রচারণা শুরু হবে ২২ জানুয়ারি। প্রচার চালানো যাবে ১০ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। আর ভোটগ্রহণ করা হবে ১২ ফেব্রুয়ারি।