
বাংলাদেশে সোনার দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়েছে ৩০ হাজার টাকা। প্রতি ভরি সোনার দাম এখন লাখ টাকা ছাড়িয়েছে, যা তিন বছর আগেও ছিলো ৭০ হাজার টাকার কম। শুক্রবার থেকে কার্যকর হয়েছে সোনার দাম যেখানে ভালো কোয়ালিটির সোনার বিক্রি হচ্ছে ১ লাখ ৭৭৭ টাকায়। বাংলাদেশে সোনার দাম বাড়ানো কিংবা কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি বা বাজুস। গত মার্চেই তারা দাম প্রায় সাড়ে সাত হাজার টাকা বাড়িয়েছিলো। এরপর সাতই জুন বাড়িয়েছিলো আরও প্রায় দু হাজার টাকা। মাঝে অল্প কিছু কমে আবার বেড়ে সর্বশেষ দাম ছিলো ৯৮ হাজার ৪৪৪ টাকা। শেষ পর্যন্ত আজ প্রতি ভরির দাম ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এক লাখ টাকার মাইলস্টোন অতিক্রম করলো।
প্রতিবেশি দেশ ভারতের সাথে তুলনা করলে বাংলাদেশের সোনার দাম অনেকটা লাগামছাড়া বৃদ্ধি পেয়েছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতে দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ। ভারতের গত তিন বছরে ভরি প্রতি সোনার দাম প্রায় আট হাজার রুপি বাড়লেও বাংলাদেশে বেড়েছে প্রায় ত্রিশ হাজার টাকা। শুক্রবার প্রতিবেশী ভারতে ২২ ক্যারেটের আজকের মূল্য ৫৫ হাজার ৪০০ ভারতীয় টাকা আর ২৪ ক্যারেট ৬০ হাজার ৪৪০টাকা। তিন বছর আগে ভারতের একই পরিমাণ ২২ ক্যারেট সোনার দাম ছিলো ৪৮ হাজার ৯০৬ টাকা আর ২৪ ক্যারেট ছিলো ৫২ হাজার ৫১৫ টাকা। আর তিন বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালে বাংলাদেশের সোনার ভরি ছিলো ৭০ হাজার টাকার সামান্য কম।
এতো দামের কারণ কী?
সোনার আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি’ আর ‘অকার্যকর আমদানি নীতি’র কারণেই সোনার দাম বেড়েই চলেছে ,যা কমার লক্ষণ খুব একটা নেই বলেই মনে করেন তারা। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতি দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখলেও এতো দাম হওয়া উচিত নয়। বরং সোনার যথাযথ বাজার মেকানিজম না থাকাকেই দাম অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাওয়ার জন্য দায়ী বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা বলেন, বাংলাদেশে সোনার দামের ক্ষেত্রে উল্লম্ফন ঘটেছে কিন্তু এই উল্লম্ফনের কোনো ‘যৌক্তিক ও সুনির্দিষ্ট’ কারণ নেই। যুদ্ধ ও অন্যান্য কারণে দাম বাড়বে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে এতোটা বাড়বে কেন? কার্যকর বাজার ব্যবস্থা ও রেগুলেশন্স না থাকায় সোনার দাম এভাবে আকাশচুম্বী হচ্ছে।
যদিও চলতি বছরের শুরুতেই বিশেষজ্ঞরা আভাস দিয়েছিলেন যে এ বছর সোনার দাম অনেক বেড়ে যেতে পারে। বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারিতে বাংলাদেশে প্রতি ভরি সোনার দাম ছিলো ৯৩ হাজার ৪২৯ টাকা। জুলাইতে এসে এই দাম এক লাখ অতিক্রম করলো এবং এই দাম শিগগিরই কমে আসার কোনো সম্ভাবনাও দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়াল বলছেন, রাশিয়া সোনার উৎপাদনকারী বড় দেশ এবং যুদ্ধের জের ধরে কয়েক বছর ধরে নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার স্বর্ণ বাজারে আসছে না। হঠাৎ করে কাল যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেলে হয়তো দাম কমতে পারে। এছাড়া ডলারের বিনিময় হার, ক্রুড ওয়েলের দাম সহ আনুষঙ্গিক বিষয় বিবেচনা নিলে বলতে হয় দাম কমার আপাতত কোনো লক্ষণ আমরা দেখছি না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুদের হার বৃদ্ধি এবং মন্দার আশঙ্কার কারণে বিশ্ব বাজার অনিশ্চিত হয়ে পড়ার কারণে সোনার দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা করছিলেন অনেকে। আবার বিশ্বের অনেক দেশে মুদ্রাস্ফীতি ধারণার চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে গত বছর ব্যাংকগুলো সোনাতেই বেশি বিনিয়োগ করছিলো। একই সাথে ডলারের দাম ব্যাপক বেড়ে যাওয়াকেও অনেকে সোনার দাম বৃদ্ধির জন্য দায়ী করে থাকেন। আবার অন্য বৈশ্বিক মুদ্রার সাথে ডলারের দাম কমে গেলেও সোনার দাম বেড়েছে। অনেক বিশ্লেষক অবশ্য কোভিড মহামারির পর আবার যুদ্ধ পরিস্থিতি ও চীনের অর্থনীতির গতি ধীর হওয়াকেও সোনার দাম বৃদ্ধির জন্য অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
দাম কমার সুযোগ আছে ?
বাংলাদেশের সোনার চাহিদা কত তার সঠিক কোনো হিসেব নেই এবং দেশটিতে আগে সোনার বাজারের পুরোটাই ছিলো অপ্রদর্শিত সরবরাহ ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তবে সোনা নীতিমালা হওয়ায় বৈধ আমদানির সুযোগ হয়েছে এবং এ নীতিমালায় বলা হয়েছে দেশে এখন বার্ষিক ২০থেকে ৪০ মেট্রিক টন চাহিদা তৈরি হচ্ছে। এখন বাংলাদেশে লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানগুলো সোনা আমদানি করতে পারে। এছাড়া বিমানযাত্রীরা ব্যাগেজ রুলসের আওতায় শুল্ক পরিশোধ করে সোনা আনতে পারে। তবে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ হচ্ছে, বাণিজ্যিক আমদানির চেয়ে ব্যাগেজ রুলসের মাধ্যমে সোনা আনার খরচ কম হওয়ায় আমদানি কম হচ্ছে এবং সরকার রাজস্ব কম পাচ্ছে।
বাজুসের সাবেক প্রেসিডেন্ট এনামুল হক খান বলছেন, বাংলাদেশে মাঝে প্রায় দুই দশক স্বর্ণের দাম স্থিতিশীল ছিলো। তখন যদি নিয়মিত দাম সমন্বয় হতো তাহলে এখন দাম এতো বেশি মনে হতো না। তবে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো স্বর্ণ নীতিমালা হলেও আমদানি নীতি অকার্যকর হয়ে আছে ভুল নীতির কারণে। শুধু ভুল নীতির কারণেই স্বর্ণের দাম বাজারে ভরি প্রতি ৮/১০ হাজার টাকা বেশি। আগে ২০ ভরি সোনা আনলে যে কর দিতে হতো এখন ভুল নীতির কারণে এর অর্ধেক আনলেই একই কর দিতে হয়। এগুলো সংশোধন করলে দাম কিছুটা কমতে পারে। একই সাথে বাংলাদেশের স্বর্ণের রিফাইনারি তৈরির যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সেটি সম্পন্ন হলেও বাজারে দামের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
যদিও সায়মা হক বিদিশা বলছেন, সরকার বৈধভাবে স্বর্ণ আনা ও ব্যবসার সুযোগ দিলেও বাজারে তার প্রভাব পড়েনি অর্থাৎ এর সুফল ভোক্তারা পাচ্ছে না। এখানে স্বর্ণের মার্কেট স্বাভাবিক না। চাহিদা যোগানের তত্ত্বও এখানে কাজ করে না। কারণ বিধি বিধান বা রেগুলেশন্স খুব একটা কার্যকর করা যায়নি। যুদ্ধ হচ্ছে কয়েক বছর । কিন্তু সেটিকে দেখিয়ে কত বাড়বে দাম? সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বর্ণের বাজারের মেকানিজম দেখা উচিত। আমদানি নীতি থেকে শুরু করে দরকারি ব্যবস্থাগুলোতে গুরুত্ব দেয়া উচিত।