আন্তর্জাতিক

যেভাবে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ হয়ে উঠেছিলেন বারাণসীর মণিকর্ণিকা

বাংলার কথা বাংলার কথা

প্রকাশিত: ১২:৫৫ অপরাহ্ণ, জুন ৩০, ২০২৩

ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাও পাঁচ বছরের একটি শিশুকে দত্তক নেওয়ার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। তারিখটা ছিল ১৮৫৩-র ২০ নভেম্বর। শিশুটির নাম ছিল দামোদর রাও। ওই অনুষ্ঠানে তিনি ব্রিটিশ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিনিধি মেজর এলিসকেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানের পরে মেজর এলিস ইংরেজিতে বক্তৃতা দেন। সেখানে হাজির বেশিরভাগ মানুষই সেই বক্তৃতার মানে বুঝতে পারে নি। বক্তৃতার শেষ বাক্যটি ছিল এরকম, ‘ইয়োর হাইনেস, ব্রিটিশ সরকার যাতে আপনার ইচ্ছাকে সম্মান দেয়, তার জন্য আমি সবরকম চেষ্টা করব।”

পরের দিন ভোর সাড়ে ৪টায় ঝাঁসির সপ্তম রাজা গঙ্গাধর রাও মারা যান। প্রায় চার মাস পরে ১৮৫৪ সালের ১৫ মার্চ বেলা ১১টার দিকে মেজর এলিস ঝাঁসি দুর্গের ফটকে পৌঁছে রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিনি রানিকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে ওই বৈঠকে তার মন্ত্রীরাও উপস্থিত থাকেন।

‘আমার ঝাঁসি আমি দেব না’
ক্রিস্টোফার হিবার্ট তার ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান মিউটিনি ১৮৫৭’ বইতে লিখেছেন, “মেজর এলিস তার গলা পরিষ্কার করে বললেন যে তিনি কলকাতা থেকে একটি বার্তা পেয়েছেন। রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের দত্তক নেওয়া উত্তরাধিকারী হিসাবে দামোদর রাওকে ঝাঁসির রাজা হিসাবে মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন ভারতের গভর্নর জেনারেল। ফলে ব্রিটিশ সরকার ঝাঁসি রাজ্য অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। “এখন থেকে ঝাঁসি রাজ্যের নাগরিকরা ব্রিটিশ সরকারের অধীনে থাকবে এবং সব পাওনা কর সরকারকে দেবে,” মেজর এলিসকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন হিবার্ট।

একজন অনুবাদক অ্যালিসের বক্তব্য মারাঠি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। মেজর এলিসের কথা শুনে রানি লক্ষ্মীবাঈ তার আসন থেকে ওঠার চেষ্টা করলেন। তার এক সহকারী তার হাতটা আলতো করে ধরে তাকে থামালেন। রানি আবারও বসলেন নিজের আসনে। কিছুক্ষণ নীরবতার পরে দৃপ্ত গলায় রানি বললেন, “আমার ঝাঁসি আমি দেব না।“

মেজর এলিস তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, “ইয়োর হাইনেস, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব যাতে আপনাকে পর্যাপ্ত অর্থ দেওয়া যায়। এটাও নিশ্চিত করব যাতে ব্রিটিশ সরকার আপনার সঙ্গে ভাল আচরণ করে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই সিদ্ধান্তের নিন্দা জানাই। আমি খুবই দুঃখিত যে আমাকে এই সিদ্ধান্ত জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।“

রানি তার সমস্ত মন্ত্রী, আত্মীয় এবং সহকারীকে চলে যেতে বললেন এবং নিজে একটি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত
সন্ধ্যের মধ্যেই ঝাঁসির দুর্গে দলে দলে মানুষ জড়ো হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশদের ঝাঁসি দখলের খবর আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। দোকানপাট বন্ধ করে দিয়েছিল ব্যবসায়ীরা। ব্রিটিশ সরকারের ওই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সেদিন কেউ ঘরে বাতি জ্বালাবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পুরো শহর জুড়ে অন্ধকার নেমে এসেছিল। রানি তার বাবার মাধ্যমে প্রজাদের কাছে বার্তা পাঠালেন, “তোমরা শান্তিতে ঘরে যাও। এখনও সব শেষ হয়নি। আমরা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু তোমাদের রানি একটা পথ খুঁজে বার করবেন।“

এর পর রানি লক্ষ্মীবাঈ তার বিশেষ উপদেষ্টা দিওয়ান নরনসেন, কাশ্মীর মল এবং নিজের বাবা মরোপন্ত তাম্বেকে তার ঘরে ডেকে বললেন, “আমি এর বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের সেনাবাহিনী আছে এবং ঝাঁসির মানুষ আমার সঙ্গে আছে। আমি তাদের নেতৃত্ব দেব এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করব। আমরা হেরে যেতে পারি কিন্তু অপমানিত হওয়ার থেকে তো বাঁচব।

বারাণসীর মণিকর্ণিকা
রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের ছোটবেলার নাম ছিল মণিকর্ণিকা। তিনি বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরোপন্ত তাম্বে ছিলেন পদচ্যুত মারাঠা পেশওয়াদের উপদেষ্টা। লক্ষ্মীবাঈ যখন খুব ছোট ছিলেন তখন তার মা মারা যান। ছোটবেলা থেকেই তিনি ঘোড়ায় চড়া আর তলোয়ার চালানো শিখেছিলেন। ইরা মুখৌটি তার ‘হিরোইনস, পাওয়ারফুল ইন্ডিয়ান উইমেন অফ মিথ অ্যান্ড হিস্ট্রি’ বইতে লিখেছেন, “ রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের সাথে বিয়ের সময় রানির নাম মণিকর্ণিকা থেকে পরিবর্তন করে লক্ষ্মীবাঈ করা হয়েছিল। গঙ্গাধর রাওয়ের জীবৎকালে, প্রায় ১০ বছর ঝাঁসির রানি ছিলেন তিনি। রাজার প্রথম স্ত্রী আগের বছরই গত হয়েছিলেন। মণিকর্ণিকার বাবা মরোপন্ত তাম্বে বিয়ের পরে মেয়ের সঙ্গেই তার শ্বশুর বাড়িতে এসেছিলেন এবং ঝাঁসিতেই থাকতে শুরু করেছিলেন।

ডালহৌসির ‘ডকট্রিন অফ ল্যাপস’
ঝাঁসির রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের সঙ্গে লক্ষ্মীবাঈয়ের বিয়ে হয় মাত্র ১৫ বছর বয়সে, ১৮৪৩ সালে। তাদের একটি পুত্রসন্তান হলেও মাত্র চার মাস বয়সে শিশুটির মৃত্যু হয়েছিল। সেজন্য রাজা গঙ্গাধর রাও মারা যাবার আগে দামোদর রাওকে দত্তক নিয়েছিলেন। ভারতের গভর্নর জেনারেল বা বড়লাট হিসেবে আসেন লর্ড ডালহৌসি – মাত্র ৩৬ বছর বয়সে। তিনিই ‘ডকট্রিন অফ ল্যাপস’ চালু করলেন, যে নিয়ম অনুযায়ী কোনও রাজা সন্তানহীন অবস্থায় মারা গেলে তার দত্তক নেওয়া কোনও উত্তরাধিকারীকে রাজত্ব দিয়ে যেতে পারবেন না এবং রাজ্যটি ব্রিটিশ সরকারের হাতে চলে যাবে। এইভাবেই ব্রিটিশরা পাঞ্জাব, সিকিম, আওধ এবং উদয়পুর দখল করেছিল। ঝাঁসিকেও এই ডকট্রিন অনুযায়ী ব্রিটিশ রাজের অংশ হিসাবে ঘোষণা করা হলে রানি গভর্নর জেনারেলকে চিঠি লিখে এক মাসের সময় চেয়েছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশরা তা প্রত্যাখ্যান করে এবং তাদের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে তিনতলা ভবন ‘রানি মহলে’ যেতে বাধ্য করে।

রাজা গঙ্গাধরের অদ্ভুত শখ
রাজা গঙ্গাধর রাওয়ের একটা অদ্ভুত শখ ছিল। তিনি নারীদের মতো করে সাজতে ভালবাসতেন। বিষ্ণু ভট্ট গডসে তখন ঝাঁসিতে থাকতেন। তাঁর আত্মজীবনী ‘মাই ট্রাভেলস, দ্য স্টোরি অফ দ্য ১৮৫৭ মিউটিনি’-তে লিখেছেন, ‘গুজব ছড়িয়েছিল যে গঙ্গাধর রাও নাকি কখনও কখনও নারীদের মতো আচরণ করতে শুরু করেছেন। “তিনি হঠাৎ প্রাসাদের ছাদে চলে যেতেন, পুরুষদের পোশাক বদলিয়ে শাড়ি-চোলি পরতেন। হাতে চুড়ি, গলায় মুক্তোর মালা, নাকছাবি, পায়ে মলও পরতেন তিনি,” লিখেছেন বিষ্ণু ভট্ট গডসে। লক্ষ্মীবাঈ তার স্বামী সম্পর্কে কী ভাবতেন, সে সম্পর্কে কোন প্রামাণিক প্রমাণ বা দলিল নেই।

কেমন দেখতে ছিলেন রানি লক্ষ্মী বাঈ?
রানি লক্ষ্মীবাঈ তখন সে যুগের বিখ্যাত আইনজীবী জন ল্যাংয়ের পরামর্শ করেন। ল্যাং অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা ছিলেন এবং ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা জিতেছিলেন। তিনি মিরাটে থাকতেন আর সেখান থেকে ‘মুফাসসিল’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। তিনি ফারসি ও হিন্দুস্তানি বলতে জানতেন। রানি তাকে ঝাঁসিতে ডেকে গোটা বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। রীতি অনুযায়ী রানি পর্দার আড়ালেই ছিলেন, কিন্তু ঘটনাচক্রে মি. ল্যাং রানিকে দেখে ফেলেন।

জন ল্যাং তার বই ‘ইন দ্য কোর্ট অফ রানি অফ ঝাঁসি’-তে লিখেছেন, ‘রানির পুত্র হঠাৎই পর্দাটা সরিয়ে ফেলেছিল আর আমি কয়েক মুহুর্তের জন্য রানিকে দেখার সুযোগ পেলাম। তিনি ছিলেন মাঝারি উচ্চতার এক নারী, মুখটা গোলাকার। গায়ের রং ছিল গমের মতো। একটি সোনার কানের দুল ছাড়া আর কোনও গয়না ছিল না। তার পরনে ছিল সাদা মসলিনের শাড়ি। ‘তার গলার আওয়াজ খুব কর্কশ ছিল। ছেলে পর্দা সরিয়ে দিতেই তিনি একটু রেগে গেলেন, তারপর হাসতে হাসতে বললেন, ‘আশা করি আমাকে দেখার পরে আমার প্রতি তোমার সহানুভূতি কমে যাবে না।’ এর জবাবে আমি বলেছিলাম, ‘গভর্নর জেনারেল যদি আমার মতো তোমাকে দেখার সুযোগ পেতেন, তিনি অবিলম্বে তোমাকে ঝাঁসি ফিরিয়ে দিতেন।’

ব্রিটিশদের কাছে আবেদন
ল্যাংয়ের সঙ্গে রানির কয়েক ঘন্টা ধরে পরামর্শ চলল। মি. ল্যাংয়ের সাহায্যে গভর্নর জেনারেল ডালহৌসির কাছে আবেদন করেন রানি। তাকে ১৮০৪, ১৮১৭ এবং ১৮৩২ সালের চুক্তির কথা মনে করিয়ে দিয়ে রানি লক্ষ্মীবাঈ লিখলেন, যে ওইসব চুক্তিতেই রামচন্দ্র রাও এবং তার উত্তরাধিকারীদের ঝাঁসির শাসনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু ডালহৌসি সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশরা ঝাঁসি দখল করল ১৮৫৪ সালে। ক্যাপ্টেন আলেকজান্ডার স্কিনকে ঝাঁসিতে সুপারিন্টেনডেন্ট হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। রানির পেনশন নির্ধারিত হয় এবং ব্রিটিশরা কৃষকদের কাছ থেকে জমির কর আদায় শুরু করে। এক সময় রানিও বারাণসীতে ফিরে যাওয়ার জন্য মনস্থির করে ফেলেছিলেন কিন্তু তার উপদেষ্টারা ফিরে যেতে নিষেধ করেছিলেন।তখনই লক্ষ্মীবাঈ আবার ঘোড়ায় চড়া শুরু করেন। তাকে ঝাঁসির চারপাশে ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে দেখা যেত। তখন যদিও তিনি আর রানি ছিলেন না, তবুও প্রতি সন্ধ্যায় নিয়ম করে তার দরবার বসত। তিনি প্রায়ই সাদা রঙের চান্দেরি শাড়ি পরতেন কিন্তু কখনও আবার পুরুষদের মতো ঢোলা পায়জামা, আঁটোসাটো কোটও পরতেন, মাথায় থাকত পাগড়ি। ঝাঁসি দখলের বিরুদ্ধে বারে বারেই তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করতে থাকেন ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ব্রিটিশরা তার কথা শোনেনি।

১৮৫৭-র বিদ্রোহ
মিরাটে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয় ১৮৫৭ সালের মে মাসে। খুব দ্রুতই উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহ। ঝাঁসিতে অবস্থানরত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সৈন্যই ছিল ভারতীয়। দ্বাদশ নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সৈন্যরা ৫ জুন, ১৮৫৭ ঝাঁসি দুর্গ দখল করে কারাগারে থাকা সব বন্দীদের মুক্তি দিয়ে দেয়। ঝাঁসিতে যেসব ব্রিটিশরা ছিলেন, তারা প্রাণ বাঁচাতে দুর্গে আশ্রয় নেন আর তাদের রক্ষা করার জন্য রানি লক্ষ্মীবাঈকে বার্তা পাঠান। কিন্তু রানি কোনও জবাব দেন নি।

তিনদিনের মধ্যেই সেখানে বসবাসকারী সব ব্রিটিশ নারী-পুরুষ আর শিশুকে হত্যা করা হয়। ব্রিটিশরা পরে দাবি করেছিল যে ওই হত্যাকাণ্ডের পিছনে রানির সমর্থন ছিল, তবে এর পক্ষে কোনও জোরদার প্রমাণ নেই। বিদ্রোহী সৈন্যরা দিল্লির দিকে রওনা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রানি ঝাঁসির নিরাপত্তার দিকে মনোযোগ দিলেন। তিনি ততদিনে ‘রানি মহল’ থেকে দুর্গের ভেতরে তার প্রাসাদে ফেরত চলে এসেছেন, প্রতিদিন নিয়ম করে দরবারও বসাচ্ছেন। ঝাঁসিতে আবারও শুরু হয় অস্ত্র, বন্দুক, গুলি আর বারুদ তৈরি। লক্ষ্মী বাঈ একটি টাকশালও চালু করেছিলেন। গরীবদের মধ্যে খাবার আর বস্ত্র বিতরণ করা হত। ওই সময়েই তিনি সৈন্যদের মতো পোশাক পরতে শুরু করেন।

বিষ্ণু ভট্ট গডসে লিখেছেন, ‘দুটি রৌপ্য পিস্তল এবং রত্নখচিত একটি তলোয়ার তার কোমরবন্ধ থেকে ঝুলত। তিনি চুলে একটি বড় খোঁপা করতে শুরু করলেন। তাকে অনেকটা দেবীর মতো দেখতে লাগত সেই সময়ে। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সিদ্ধান্ত ততদিনে নিয়েই ফেলেছিলেন রানি লক্ষ্মীবাঈ। দুর্গে আটা, ঘি আর চিনি মজুত করা শুরু হয়। ব্রিটিশরা আক্রমণ করলে যাতে তারা প্রচণ্ড গরমে গাছের ছায়াও না পায়, তাই তিনি দুর্গের আশেপাশের সব গাছ কেটে ফেলার আদেশ দেন।

ব্রিটিশদের ঝাঁসি দুর্গ অবরোধ
ঝাঁসির রানির বিদ্রোহ দমন করতে যুক্তরাজ্য থেকে সৈন্য আনা হয়। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল হিউজ রোজ। যুদ্ধের ময়দানে ততদিনে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। ঝাঁসি দুর্গের প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার জন্য ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ১৮ পাউন্ড ওজনের তোপ দাগতে লাগল, অন্যদিকে রানি আর তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সেনার বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তাদের প্রতিরোধ দেখে জেনারেল রোজ এতটাই বিস্মিত হয়েছিলেন যে এম. ম্যান্সফিল্ডকে পাঠানো একটি চিঠিতে সম্ভ্রমের সঙ্গে তিনি লেখেন, ‘বিদ্রোহীদের গোলন্দাজ দলের প্রধান গোলাম ঘৌস খান একজন দুর্দান্ত গোলন্দাজ।

“নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে তিনি যেভাবে আমাদের মোকাবিলা করেছেন আর পাল্টা আক্রমণ করেছেন বারবার গোলা বর্ষণ করে, তা দেখার মতো। অনেক জায়গায় তাকে আমাদের সঙ্গে সমান তালে লড়াই করতে দেখা গেছে।‘

যুদ্ধের মধ্যেই প্রতিদিন বিকেলে রানি ঘোড়ায় চড়ে তার ঘাঁটি পরিদর্শন করতেন, আর সৈন্যদের উৎসাহ দিতেন। তবে রানির সেনাবাহিনী বেশিদিন ব্রিটিশদের চাপ সহ্য করতে পারেনি। ব্রিটিশ সৈন্যরা ৩ এপ্রিল, ১৮৫৮ সালে ঝাঁসি দুর্গের প্রাচীর লঙ্ঘন করতে সফল হয়।

দুর্গ ত্যাগ করলেন রানি
সেটা ছিল ৩ এপ্রিলের মাঝরাত। রানি লক্ষ্মীবাঈ তার কয়েকশ সৈন্যকে দুর্গের চত্বরে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দেন। ইরা মুখৌটি লিখেছেন, ‘রানি তার ঘোড়সওয়ার সৈন্যদের নিয়ে দুর্গ থেকে নেমে এসে একটা খোলা মাঠে হাজির হলেন। একটি রূপালী রঙের ঘোড়ায় চড়েছিলেন তিনি। হাতে ছিল রূপার হাতল দেওয়া একটি তলোয়ার।

রানি পরের কয়েক সপ্তাহ বুন্দেলখণ্ডের গ্রামীণ এলাকায় কাটিয়েছেন। সেখানে তখন এত গরম ছিল যে হাতিদের চোখ থেকেও জল বেরিয়ে আসত। রানি এবং তার সৈন্যরা প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কাল্পিতে পৌঁছান। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের অন্যতম নেতা তাঁতিয়া টোপি আর তার সহযোগীরা আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে বিষ্ণু ভট্ট গডসে রানির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘রানি একজন পাঠান পুরুষের মতো পোশাক পরেছিলেন। তার মুখ ধুলোয় ঢেকে গিয়েছিল, খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল।

রানির গোয়ালিয়রের দুর্গ দখল
রানি লক্ষ্মীবাঈ, তাঁতিয়া টোপি আর তার সহযোগীরা কাল্পি থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন। তাদের পরবর্তী গন্তব্য ছিল গোয়ালিয়র। সেখানে তারা গোয়ালিয়রের দুর্গ দখল করেন। মহারাজা জয়াজিরাও সিন্ধিয়া সেখান থেকে পালিয়ে ব্রিটিশদের আশ্রয়ে আগ্রা পৌঁছন। কিন্তু সিন্ধিয়ার সৈন্যরা বিদ্রোহ করে রানির সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দেয়। রানি লক্ষ্মীবাঈকে সিন্ধিয়ার কোষাগার থেকে একটি অমূল্য মুক্তার মালা উপহার দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে রানির সৈন্যদের মোকাবিলা করার জন্য আবারও ব্রিটিশ জেনারেল হিউজ রোজকে গোয়ালিয়রে পাঠানো হল। তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করার সময়ে ইংরেজ সৈন্যদের আক্রমণে লক্ষ্মীবাঈ তার ঘোড়া থেকে পড়ে যান। সেই সময় সেখানে ছিলেন ক্যাপ্টেন ক্লিমেন্ট ওয়াকার।

পরে ওই যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘ঘোড়ায় চড়ে, হাতে তলোয়ার নিয়ে এক নারীকে সব জায়গায় দেখা যাচ্ছিল। আমাদের এক সৈন্য তার মাথায় আঘাত করে। যখন তিনি পড়ে যান,তখন আমরা জানতে পারলাম তিনিই ঝাঁসির রানি।‘

গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিংয়ের লেখাতেও ওই যুদ্ধের বিবরণ পাওয়া যায়। ‘তার ঘোড়াটিকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়েছিল, সেটি আর নড়াচড়া করছিল না। তিনি (রানি) ব্রিটিশ সৈন্যদের লক্ষ্য করে গুলি চালান কিন্তু তার আগেই মাথায় আঘাত লাগে।‘

হিউজ রোজের লেখায় আর আট নম্বর হুসার্স রেজিমেন্টের ইতিহাসেও রানির ব্যতিক্রমী সাহস আর বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা পাওয়া যায়। আট নম্বর হুসার্স রেজিমেন্টাল ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে যে ‘রানির মৃত্যুর সঙ্গেই বিদ্রোহীরা তাদের সবথেকে সাহসী এবং সেরা সৈনিককে হারিয়েছিল।‘

রানির শেষ মুহূর্ত
গ্রিসের প্রিন্স মিশেলের ‘দ্য কুইন অফ ঝাঁসি’ বইয়ে রানির শেষ মুহূর্ত বর্ণনা করা হয়েছে। প্রিন্স মিশেল লিখেছেন, ‘রানির সৈন্যরা তাকে তুলে নিয়ে আসে পাশের একটা মন্দিরে। সেখানকার পুরোহিত গঙ্গার জল দিয়ে রানির শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে দেন। রানি তখন শেষ নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। ভাঙ্গা গলায় তিনি বললেন, “আমি দামোদরকে তোমাদের দায়িত্বে রেখে যাচ্ছি।“

রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের স্বামী, রাজা গঙ্গাধর রাও মৃত্যুর ঠিক আগের দিন দামোদর রাওকে দত্তক পুত্র হিসাবে অনুষ্ঠান করে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। গলা থেকে মুক্তার মালাটা খোলার চেষ্টা করলেন রানি। তারপর কোনওমতে বললেন, “আমি চাই না যে ব্রিটিশরা আমার মৃতদেহটা পাক।“ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই রানি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। সেখানে উপস্থিত রানির সৈন্যরা কিছু কাঠ জড়ো করে তার মৃতদেহ জ্বালিয়ে দেয়। যখন রডরিক ব্রিগস মন্দিরে পৌঁছলেন, সেখানে সবকিছু একেবারে শান্ত ছিল। রানির অনেক সৈন্যদের রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়ে ছিল সেখানে। তখনই তার চোখে পড়ে একটি চিতা। চিতাটা তখন প্রায় নিভে আসছে। বুট দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন মি. ব্রিগস। তখনই তিনি দেখতে পান পোড়া দেহাবশেষ। হাড়গুলো প্রায় ছাই হয়ে গিয়েছিল।‘


সূত্র : বিবিসি নিউজ বাংলা