
অনেকেই কাঁচা মরিচ বা শুকনা মরিচের ঝাল কিংবা অতিরিক্ত মশলাদার খাবার সহ্য করতে পারেন না। অল্প মরিচের ঝালেই তারা গরম বোধ করতে থাকেন, পানি বা মিষ্টি কিছু খাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন, অনেকে বিরক্তও হয়ে যান। এরকম কিছু কি আছে যা দিয়ে মশলাযুক্ত অথবা ঝাল খাবার সহ্য করা যায়? বিজ্ঞানী থেকে শুরু করে মরিচ চাষীর মত বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে এই বিষয়ে জানার চেষ্টা করেছে বিবিসি।
আপনার বন্ধুরা যখন ঝাল খাবার খেয়ে সেটা উপভোগ করেন, তখন কি আপনার মনে হয় এই একই খাবার খেয়ে আপনার নাক ও মুখ জ্বলতে শুরু করবে? নাক-কান দিয়ে ধোঁয়া বেরুবে? হতেই পারে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, আপনি যদি ঝাল খাবারের স্বাদ উপভোগ করতে চান তাহলে ভয় পেলে চলবে না-আপনাকে জানতে হবে ও শিখতে হবে কীভাবে ঝাল খাবার সহ্য করা যায়- এমনকি ভালোবেসে খাওয়া যায়।
একটি মরিচ খামারের মালি ওয়েন রজারের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তার খামারে প্রায় ১৫ ধরনের মরিচ উৎপন্ন হয়। কিছু মরিচের ঝাল কম আর কিছু মরিচ ভয়াবহ ঝাল। মরিচের প্রতি তার আগ্রহ তৈরির পর থেকে কয়েক বছরের মধ্যে রজার প্রায় সব ধরনের ঝাল খাবারের স্বাদ নেয়া শিখে গেছেন। তিনি বলেন, যখন আমি এই ব্যবসা শুরু করি তখন ঝাল খাবার আমার একদমই পছন্দের ছিল না। কিন্তু কয়েক বছরে এটা পাল্টে গেছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সময়ের সাথে সাথে ঝাল খাবারের স্বাদ নেয়া ও এমন খাবার খেয়ে মানুষের যে প্রতিক্রিয়া, তাতে পরিবর্তন আসতে পারে।কিন্তু কীভাবে এটা কাজ করে?
মরিচ খেলে ঝাল লাগে কেন? কী কারণে খাবার ঝাল হয়?
“ঝালের অনুভূতি তৈরি করে ক্যাপসাইসিন”- ব্যাখ্যা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যামের ফ্লেভার সায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক ড. কিয়ান ইয়াং।মরিচ বিভিন্ন প্রজাতির হয়, বিভিন্ন আকারের হয়। একেক ধরনের মরিচের বৈশিষ্ট্য আলাদা হলেও যেটি প্রায় সব মরিচের মধ্যেই থাকে – সেটা হলো ঝাল। মরিচ গাছের ভেতরে ‘ক্যাপসাইসিন’ নামে এক ধরনের রাসায়নিক উৎপন্ন হয়। মরিচ ঝাল লাগার কারণ হলো ক্যাপসাইসিনের উপস্থিতি।
আমরা যখন ঝাল কোনও খাবার খাই, তখন মরিচে থাকা ক্যাপসাইসিন আমাদের মুখে থাকা ‘পলিমোডাল’ স্নায়ুকে (পলিমোডাল নসিসেপ্টর নার্ভস) উত্তেজিত করে তোলে। এই পলিমোডাল স্নায়ুর কাজ হলো ব্যথা, তাপমাত্রা ও ঝাল শনাক্ত করা। এছাড়া এগুলো কত তীব্র সেই ধারণা সম্পর্কেও আমাদের মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায় এই স্নায়ু। ঝাল জাতীয় কিছু খাওয়ার সময় পলিমোডাল স্নায়ু উত্তেজিত হয় এবং দেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুর (সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম) মাধ্যমে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায়। আমাদের মস্তিষ্ক সেই সংকেত বিশ্লেষণ করে সেটা কোন ধরনের অনুভূতি, তা আমাদের জানিয়ে দেয়।
মরিচে থাকা ক্যাপসাইসিন যখন স্নায়ুকে উত্তেজিত করে তোলে, তখন মস্তিষ্ক ঝালের মাধ্যমে সৃষ্ট ‘বার্নিং সেনসেশন’ বা ‘পুড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি’ চিহ্নিত করে। যখন খাবারের মাধ্যমে আমরা ক্যাপসাইসিন গ্রহণ করি, তখন সেটা আমাদের জিহ্বায় পেইন রিসেপ্টরগুলোর সাথে যুক্ত হয় , নির্দিষ্টভাবে বলা যায় টিআরপিভি ওয়ান রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয়। আর এটাই সেই জ্বলন্ত অনুভূতি তৈরি করে। অধিকাংশ মানুষ মনে করেন, মরিচের সবচেয়ে ঝাল অংশ হলো এর বীজ। প্রকৃতপক্ষে, মরিচের আগা থেকে নিচের দিকে বর্ধিত সাদা স্পঞ্জি স্তর বা প্ল্যাসেন্টাতেই উৎপন্ন হয় ক্যাপসাইসিন, আর এটা খেয়েই ঝাল লাগে।
স্কোভিল স্কেল দিয়ে ঝাল পরিমাপ
বিভিন্ন ধরনের মরিচে বিভিন্ন ধরনের ক্যাপসাইসিন থাকে, আর তাতে এই ক্যাপসাইসিনের ঘনত্বও থাকে ভিন্ন ভিন্ন। কিছু মরিচ একদম কম, আর কিছু মরিচ তীব্র জ্বলন্ত অনুভূতি তৈরি করে। এটা পরিমাপ করা হয় স্কোভিল স্কেল দিয়ে। এটা ঝাল পরিমাপের একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি। রসায়নবিদ উইলবার স্কোভিল ১৯১২ সালে একটি মরিচের ঝালের উত্তাপ বর্ণনা করার জন্য যে পদ্ধতি গ্রহণ করেন, তা-ই স্কোভিল হিট ইউনিট হিসেবে পরিচিত।
এ পদ্ধতিতে মরিচের ঝাল শনাক্ত না হওয়া পর্যন্ত পানিতে চিনি মিশ্রিত করা হয়, এর মান যত বেশি হবে, বুঝে নিতে হবে মরিচের ঝালও তত বেশি।বিশ্বের অন্যতম ঝাল মরিচ, নাগার স্কোভিল স্কেলে ঝালের মাত্রা হয়ে থাকে ১.৩০ মিলিয়নেরও বেশি। তবে ঝালের ক্ষেত্রে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে আছে ক্যারোলিনা রিপার, যার স্কোভিল হিট ইউনিট (এসএইচইউ) মাত্রা প্রায় ১.৬৪ মিলিয়ন।
কেন কিছু মানুষ অন্যদের তুলনায় বেশি ঝাল খেতে পারে?
একেক মানুষের ঝাল সহ্য করার ক্ষমতা বা ক্যাপসাইসিনের প্রতিক্রিয়া একেক রকম। যেমন রজার ঝালের উত্তাপ সহ্য করতে পারতেন না, কিন্তু তার ব্যবসায়িক পার্টনার মিশেলের ছিল রজারের ভাষায় “ঝাল সহ্য করার অসীম ক্ষমতা। সবসময়ই সে ঝাল সহ্য করতে পারতো”।
কেন কিছু মানুষ অন্যদের তুলনা বেশি ঝাল বা মশলাদার খাবার সহ্য করতে পারে এ নিয়ে ভিন্ন কিছু তত্ত্ব রয়েছে। ইয়াং বলছেন “ঝাল বা মশলাদার খাবারের জন্য সহনশীলতা আসে প্রকৃতি ও পরিবেশের সংমিশ্রণে। যেসব দেশে উষ্ণ আবহাওয়া, যেমন ভারতের মতো আবহাওয়া যেসব দেশে আছে, সেসব দেশে মরিচ খুব ভালোভাবে জন্মায় এবং এসব দেশের মানুষের মধ্যেও ঝাল সহ্য করার প্রবণতা বেশি, কারণ তরুণ বয়স থেকেই তারা উষ্ণ আবহাওয়ায় বসবাস করতে অভ্যস্ত – ফলে সময়ের সাথে সাথে তারা ঝাল বা মশলাদার খাবারে অভ্যস্ত হয়ে যায়- এরকম একটি হাইপোথিসিস আছে। তবে এই সম্পর্কটা পুরোপুরি বুঝতে আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে জেনেটিক্সও একটি ভূমিকা পালন করে বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, একজন ব্যক্তির মরিচের ঝাল সহ্য করার ক্ষমতার ১৮-৫৮ শতাংশ কারণ জেনেটিক্সের ওপর নির্ভরশীল।
মানবদেহের স্নায়ুকোষগুলোর ক্যাপসাইসিন শনাক্ত করার মত রিসেপ্টর রয়েছে, যা আমাদের মস্তিষ্কে বিপদজনক সংকেত পাঠায়। আমাদের মস্তিষ্ক তাই বিপদের আশঙ্কা করে শরীরে এক ধরনের স্ট্রেস হরমোন নিঃসরণ করে। যার কারণে শরীর ঘামতে থাকে ও ত্বকে লালচে ভাব দেখা যায়। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, কিছু মানুষ কম রিসেপ্টর নিয়ে জন্মায়, ফলে তাদের ক্যাপসাইসিন শনাক্তের ক্ষমতা কম থাকে। অর্থাৎ ঝাল খেলে যে জ্বলন্ত অনুভূতি হয়, সেটার সম্ভাবনা কম থাকে। আর বিপরীত দিকে যাদের বেশি রিসেপ্টর থাকে, তারা ঝাল নিয়ে রীতিমতো ‘স্ট্রাগল’ করে।
ভিন্ন আরেকটি গবেষণায় বলা হচ্ছে, ঝাল খাবার গ্রহণের ক্ষমতা নির্ভর করে মানুষের ব্যক্তিত্বের ওপর। এ নিয়ে গবেষণা করেছেন পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জন হেইস এবং ডা. নাদিয়া বায়ার্ন। তাদের একটি গবেষণার ফলাফলে বলা হয়েছে, “মেক্সিকোতে সুঠাম দেহের অধিকারী, সাহসী ও শক্তিশালী বৈশিষ্ট্যের ব্যক্তিত্বের ওপর নির্ভর করে মরিচের ঝাল গ্রহণের ক্ষমতা।” অন্যদিকে, আমেরিকান কলেজ ছাত্ররা মরিচ খাওয়ার বিষয়টাকে তুলনা করে রোমাঞ্চকর বা অ্যাডভেঞ্চারমূলক কার্যকলাপের সঙ্গে। যেমন রোলার কোস্টারে চড়া, জুয়া খেলা বা অ্যালকোহল খাওয়ার মতো বিষয়ের সঙ্গে মেলায় এটাকে। গবেষকরা বলছেন, যারা রোমাঞ্চের খোঁজে থাকেন তারা হয়তো মরিচের ঝালটাকে ভালোভাবে সামলাতে পারেন।
কীভাবে ঝাল খাবার খাওয়ার ক্ষমতা বাড়াতে পারেন?
মরিচের ঝাল কোনও স্বাদ নয়। গবেষকরা বলছেন – মরিচ খাওয়ার পরে জ্বালা বা জ্বলন্ত ভাবটি আসে শরীরের ব্যথা প্রতিক্রিয়া থেকে। ক্যাপসাইসিন মানব কোষে টিআরপিভি ওয়ান নামক প্রোটিন সচল করে দেয়। এ প্রোটিনের কাজ হচ্ছে তাপমাত্রা শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা। যখনই উত্তাপ অনুভূত হয়; তখনই মস্তিষ্ককে সতর্ক করে দেয়, আর মস্তিষ্ক দ্রুত সাড়া দিয়ে সেই স্থানে ব্যথার সংকেত পাঠায়। ঝাল লাগার পর মানুষ পানি খেয়ে ঝাল কমানোর চেষ্টা করে কিন্তু পানি কিন্তু কাজে আসে না।কারণ ক্যাপসাইসিন পানি দ্রবণীয় না। এটা দুধ বা দুধজাতীয় খাবারে দ্রবীভূত হয়। তাই ঝাল কমানোর জন্য বিশেষজ্ঞরা দুধ বা দুধজাতীয় খাবার – যেমন দই বা আইসক্রিম – খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাদের মতে ধীরে ধীরে খাবারের মেনুতে ঝাল আইটেম যুক্ত করা হলে মানবদেহ সময়ের সাথে সাথে সেটাকে সহনীয় করে ফেলে।
“ঝাল খাবার খেয়ে যে গরম অনুভূতি হয় তা সহ্য করার জন্য ধীরে ধীরে চেষ্টা করা যেতে পারে। আস্তে আস্তে সময়ের সাথে সাথে ডায়েটে ঝাল খাবার যুক্ত করলে একটা সময় ঝাল উপভোগ্য হয়ে ওঠে” বলছেন মি. ইয়াং। ধীরে ধীরে মানুষের রিসেপ্টরগুলো ঝালের তাপমাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নেয়। একথা ভুলে গেলে চলবে না যে একেক রকম মরিচের স্বাদে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে। সুতরাং, এগুলোর স্বাদ আস্তে আস্তে উপভোগ করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ মরিচের উপাদানগুলো স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ক্যাপসাইসিন বায়োঅ্যাকটিভ কম্পাউন্ড – এটি আমাদের লিভারে ও রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে।এর প্রধান কাজ দেহের চর্বি কমানো। অনেক গবেষণায় দেখা গেছে মানুষের দীর্ঘায়ুর পেছনে এই ক্যাপসাইসিনের ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও এটি লিভারকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে যে সেখানে কোলেস্টেরল সিনথেসিস কম হয়। অর্থাৎ অতিরিক্ত কোলেস্টেরলের উৎপাদনে এটি বাধার সৃষ্টি করে।
সূত্র : বিবিসি নিউজ বাংলা