
যুক্তরাষ্ট্রে কোন রেস্তোঁরায় খেতে গেলে বা কারও কাছ থেকে কোন সেবা নিলে তাকে টিপস্ বা নির্দিষ্ট পরিমাণ বখশিশ দেয়া এক ধরনের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি বখশিশের এই সংস্কৃতি সমালোচনার মুখে পড়ে যেদিন অ্যাপল স্টোরের কর্মচারীরা গ্রাহকদের সেবা দেয়ার বিপরীতে বখশিশ চাওয়ার প্রস্তাব করে। দিন দিন বখশিশের এই সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন উত্তর আমেরিকার মানুষেরা। ইতিমধ্যেই, “গিল্ট টিপিং”, টিপিং ফ্যাটিগ”, “টিপ ক্রিপ”, “ভাইরাল টিপ শেমিং” এবং “টিপফ্লেশন” এর মতো নতুন শব্দ অভিধানে যুক্ত হয়েছে। এই বখশিশ দেয়ার সংস্কৃতি একেক দেশে একেকরকম। যেমন ফ্রান্সে, বিলের ওপর লেখা থাকে “সার্ভিস কম্প্রিস”। এর মানে হল বখশিশ ইতিমধ্যেই বিলের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অন্যদিকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এক্ষেত্রে একদমই কঠোর, তারা বখশিশ নেয়াকে অপমানজনক মনে করে। এবং বখশিশের সংস্কৃতি গড়ে না ওঠা তাদের জন্য গর্বের বিষয়। দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা এই বখশিশের প্রথা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণ তাদের প্রশংসা করার সংস্কৃতি ভিন্ন। এবং বখশিশের সংস্কৃতি সেই সমাজব্যবস্থার নানা দিক সম্পর্কে ধারণা দেয়।
জাপান : জাপান হল কঠোর সংযমী মানুষদের জন্য স্বর্গের মতো। যেখানে নোংরা আবর্জনা দেখা দূরের কথা, এর কথাও শোনা যায় না। দেশটিতে অপূর্ণতা (ওয়াবি-সাবি) বা ত্রুটিকে সম্মানের সাথে দেখা হয় এবং সামাজিক আচার আচরণকে একটি শিল্পের রূপ দেয়া হয়। যেমন খাওয়ার সময় হাঁটবেন না, গণপরিবহনে কথা বলবেন না, হাত বা চপস্টিক দিয়ে কোন দিকে নির্দেশ করবেন না, জনসমক্ষে নাকে হাত দেবেন না ইত্যাদি। জাপান এমন এক দেশ যেখানে বখশিশ দেয়া শুধু অস্বাভাবিকই নয়, বরং এটা বিব্রতকর এবং কুৎসিত বিষয় বলে মনে করা হয়। যেহেতু জাপানিদের মধ্যে সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে বখশিশ দেয়ার কোন সংস্কৃতি নেই। তাই সেখানে ভ্রমণে যাওয়া বিদেশি পর্যটকদের সতর্ক করে বলা হয় তারা যেন বখশিশ দেয়ার আগে দুবার ভাবেন। কারণ বখশিশ দেয়া রীতিমত অপরাধ করার সামিল।
যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক ট্যুর অপারেটর ইনসাইড জাপান ট্যুরসের জেমস মুন্ডি বলেছেন, জাপানিরা বখশিশ দেয়া নেয়া করে না ভ্রমণকারীদের এই কথা বলা সত্ত্বেও অনেকে টাকা দিয়ে তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করতে চান- কিন্তু জাপানে বিষয়টি সেভাবে কাজ করে না। পর্যটকরা রেস্তোরাঁয় কর্মীদের জন্য টাকা রেখে গেলে ওই কর্মীরা তাদেরকে রাস্তায় তাড়া করে টাকা ফেরত দেয়। অনেকে বুঝতে পারে না যে এখানকার মানুষ তাদের কাজ গর্বের সাথে করে।
এক্ষেত্রে সন্তুষ্টি প্রকাশে ‘ঐশিকত্তা’ (খাবার সুস্বাদু ছিল), বা ‘ গোশিও সামা” (খাবার তৈরির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ) বললেই হবে। আবার অনেকে মাথা ঝুঁকেও ধন্যবাদ জানিয়ে থাকেন। এজন্য টাকা দেয়ার প্রয়োজন নেই। তবে একটি ব্যতিক্রম রয়েছে: জাপানের ঐতিহ্যবাহী তাতামি-ম্যাটেড গেস্টহাউসে, ভ্রমণকারীরা নাকাই সান (কিমোনো-পরা সার্ভার যারা আপনার খাবার প্রস্তুত করে) এর জন্য অর্থ রেখে যেতে পারে। সেটারও বিশেষ নিয়ম আছে। তাকে সরাসরি এই বখশিশ দেয়া যাবে না। তার পরিবর্তে একটি বিশেষভাবে সাজানো খামে সেই বখশিশ ঢুকিয়ে সীলমোহর বসিয়ে দিতে হবে। সঠিকভাবে বখশিশ না দিলে তারা এটি গ্রহণ করবে না।
মিশর : উত্তর আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত সামাজিক ধারণা অনুযায়ী কাউকে বখশিশ দেয়া অর্থ কাউকে খুশি হয়ে কিছু দান করা। এসব জায়গার ট্যাক্সি চালক, ট্যুর গাইড, রাস্তার কোণার বাজারের বিক্রেতা আপনাকে সেবা দেয়ার পর সরাসরি বা ইঙ্গিতপূর্ণ ইশারায় সামান্য বখশিশ চাইতে পারে। ভুলভাবে ব্যাখ্যা করলে অনেকে বখশিশকে ভিক্ষা দেয়া বলেও মনে করতে পারেন। কিন্তু দরিদ্রদের দান করা ইসলামের পাঁচটি মূলনীতির মধ্যে একটি। কেউ বখশিশ দিলে তিনি একটি পবিত্র কাজ করেছেন বলে ভাবা হয়। ধারণা করা হয়, বখশিশ দেয়ার এই প্রথা বিশ্বের এই অংশে ভ্রমণে আসা ব্যক্তিদের উপলব্ধিকে আরও গভীর করে তুলবে।
মিশরে রেস্তোরাঁ কর্মী, ট্যাক্সি ড্রাইভার, ট্যুর গাইড এবং হোটেল কর্মীদের বখশিশ দেয়া সাধারণ বিষয়। দরজা খোলার জন্য, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, নিরাপত্তা কর্মী এবং দোকানদারদেরও এই বখশিশ দেয়া প্রযোজ্য। বখশিশকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে একে পে-ইট-ফরোয়ার্ড সিস্টেমের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যার অর্থ আপনি আজ কাউকে কিছু দিলে, কাল আপনিও কিছু পাবেন। যেমন কায়রো থেকে আসওয়ান পর্যন্ত ট্যুর গাইড এবং হোটেলের দারোয়ানদের যদি আপনি অগ্রিম বখশিশ দিয়ে থাকেন তাহলে তারা আপনাকে অগ্রাধিকারভিত্তিক এবং শীর্ষ মানের সেবা দেবেন। বখশিশ হিসেবে তারা মিশরীয় পাউন্ডের চাইতে মার্কিন ডলার পেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কেননা দেশটিতে এক মার্কিন ডলার ৩০-৪০ মিশরীয় পাউন্ডের সমান।সামান্য বখশিশ দেয়ার ফলে আপনার জন্য হয়তো, রাজাদের উপত্যকায় একটি তালাবদ্ধ মন্দিরের দরজা খুলে যেতে পারে, সবার প্রবেশাধিকার নেই এমন জাদুঘরের টয়লেট আপনার জন্য উন্মুক্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এবং ভ্রমণকারীরা এসব তথ্য পর্যটক ব্রোশারে খুঁজে পাবেন না।
চীন : বেইজিং এবং সাংহাইয়ের মতো চীনের সবচেয়ে আধুনিক ও অভিজাত শহরেও কুসংস্কার এবং ঐতিহ্যগত নানা ধারনা প্রচলিত রয়েছে। এই দেশে বখশিশ কোন প্রত্যাশিত বিষয় নয় – বরং তারা বখশিশ থেকে দূরে থাকে। চীন প্রযুক্তিগত অগ্রগতির অগ্রদূত এবং আগামী বিশ্বকে হাতছানি দিলেও এখানে বখশিশ দেয়া একসময় নিষিদ্ধ ছিল। প্রকৃতপক্ষে, চীনের একটি নীতি হল সব মানুষ সমান এবং এখানে কেউ কারও সেবক নয়; এবং অন্য কারো উপর শ্রেষ্ঠত্ব বোঝানো অনেক আগে থেকেই এখানে নিষিদ্ধ। চীনে প্রতিনিয়ত বিশালবহুল হোটেল এবং রেস্তোরাঁ গড়ে উঠলেও সেখানে কোথাও বখশিশের সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। কম পরিদর্শন করা শহর এবং শহরতলিতেও বখশিশ দেয়াকে অসভ্যতা এবং ঘুষ বলে বিবেচনা করা হয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চীনে পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক পশ্চিমা রীতিনীতির মিশ্রণ ঘটছে। এরিমধ্যে অনেক বড় ধরণের পরিবর্তনও দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া ভিত্তিক ট্যুর অপারেটর ইন্ট্রিপিড ট্রাভেলের চীনা শাখার ব্যবস্থাপক ম্যাগি তিয়ান বলেন, যদিও চীনে বখশিশ দেয়া ঐতিহাসিকভাবে অভদ্রতা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। তবে সময় বদলাচ্ছে। চীনারা এখনও বখশিশ দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলেনি। তবে বখশিশ কিছু কিছু এলাকায় এখন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে, বিশেষ করে বড় বড় শহরগুলোয় – যেখানে প্রচুর বিদেশী বাসিন্দা এবং দর্শনার্থী রয়েছেন৷ ওইসব স্থানে আপনি যদি ভ্রমণে যান, তাহলে পোর্টার, ট্যুর গাইড এবং বারটেন্ডাররা আপনাকে বিশেষ সেবা দিলে তাদের কিছু পরিমাণে বখশিশ দিতে পারেন। ঐতিহাসিকভাবে মানা থাকলেও সেখানকার স্থানীয়রাও আজকাল বখশিশ নিতে পছন্দ করেন।
যুক্তরাষ্ট্র : খুব কম দেশই বখশিশের সংস্কৃতিকে যুক্তরাষ্ট্রের মতো গুরুত্ব সহকারে নেয়। এর গুরুত্ব পরিমাপ করা একজন বিদেশী পর্যটকের পক্ষে কঠিন হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রথা হল মোট বিলের ২০-২৫ শতাংশ বখশিশ দেয়া। মাঝে মাঝে এই প্রথা মেনে চলা স্থানীয় এবং পর্যটক উভয়ের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। একে অনেক সময় টিপফ্লেশন বলা হয়ে থাকে। বাংলায় যার অর্থ হতে পারে বখশিশ স্ফীতি। অনেকটা মূল্যস্ফীতির মতো। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে প্রত্যাশিত বখশিশের পরিমাণ দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এর মধ্যে ডিজিটাল টিপিং ব্যবস্থাও যুক্ত হয়েছে। দেশটির সেবা কর্মীদের কম বেতন দেওয়ায় তারা দৈনিক বখশিশের ওপর নির্ভর করে। এমন অবস্থায় অনেক গ্যাস স্টেশন থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁগুলোয় খুচরা বিক্রেতারা তাদের প্রতিটি বিলে একটি ঐচ্ছিক সেবা চার্জ যোগ করে। অর্থাৎ আপনি বাড়তি সেবা নেন বা না নেন – আপনাকে অতিরিক্ত খরচ করতে হতে পারে।
ট্রাভেল কনসিয়ার্জ সার্ভিস নাইটসব্রিজ সার্কেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিটার অ্যান্ডারসন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো বখশিশের সংস্কৃতি অন্য কোথাও নেই। নিউইয়র্কে সম্প্রতি, আমি একটি দোকান থেকে পানির বোতল কিনেছিলাম এবং মূল্য পরিশোধের সময় তারা বখশিশ চেয়েছিল। অথচ আমি নিজেই পানির বোতল তুলে কাউন্টারে নিয়ে গিয়েছিলাম, কোন বাড়তি সেবা নেইনি, তারপরও তারা আশা করেছে আমি পানির দামের ২০% বখশিশ দেবো। অনেক জায়গায়, এটি কর্মীদের কম মজুরি দিয়ে গ্রাহকের উপর আরও চাপ বাড়ানোর একটি কৌশল মাত্র।
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে বখশিশ-বিরোধী বা নো-টিপিং আন্দোলনের দিকে এগোচ্ছে। এবং কর্মীদের ন্যায়সঙ্গত বেতন দেয়ার দাবি তুলেছে। আপাতত, মেনে নিন যে যুক্তরাষ্ট্রে বখশিশ দেয়া আইনতভাবে বৈধ কেননা দেশটির পর্যটন কর্মীদের ঘন্টায় মজুরি প্রায়শই কম হয়। কারো কাছ থেকে ভালো আচরণ পেতে হলে সেজন্য খরচ করতে হবে। কারণ ভুলে গেলে চলবে না আপনি আপনার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
ডেনমার্ক : ডেনমার্ক হল বিশ্বের অন্যতম সুখী একটি দেশ। দেশটি মূলত সমতাবাদী সমাজ, সাম্প্রদায়িক উদারতা এবং অন্যের প্রতি দয়াশীল আচরণের জন্য সুখী তালিকাভুক্ত হয়েছে। কিন্তু জেনে অবাক হবেন যে ড্যানিশরা বখশিশ-মুক্ত জাতি। এর কারণ মূলত দুটি: নাগরিকদের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় তাদের ওয়েলফেয়ার সিস্টেম কল্যাণমূলক সেবা বেশ উন্নত। একারণে সেখানকার সেবাদানকর্মী যেমন ট্যাক্সি চালক এবং সম্মুখ সারির কর্মীরা টিপসের উপর নির্ভরশীল নয় এবং সেবা বাবদ খরচ সাধারণত রেস্টুরেন্ট এবং হোটেলের বিলের ভেতরেই অন্তর্ভুক্ত থাকে।
দেশটিতে যদিও বখশিশ দেওয়া কোন ঐতিহ্য নয়, কিন্তু ডেনমার্কসহ বিস্তীর্ণ স্ক্যান্ডিনেভিয়া জুড়ে ভাংতি না দিয়ে পূর্ণাঙ্গ অর্থ দেয়ার রীতি প্রচলিত আছে। ধরুন আপনার বিল হয়তো এসেছে ২৭ ডলার, সেক্ষেত্রে আপনি ৩০ ডলার বিল পরিশোধ করবেন। আজকাল ইউরোপের প্রায় সব স্থানে সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে গ্রাহকরা দুইভাবে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। হয় তারা বখশিশ দিয়ে তাদের পুরষ্কৃত করেন, নাহলে নিয়মিত তাদের কাছে সেবা নিতে যান। এই দুটি উপায়কে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়।
** বখশিশ পরামর্শ
প্রতিটি দেশের বখশিশ দেয়ার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন নিয়ম রয়েছে। তাই বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে ভ্রমণে যাওয়ার আগে ওই দেশের বখশিশ প্রথা সম্পর্কে গবেষণা করতে ভুলবেন না। সব সময় অন্য দেশের সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি।
সূত্র : বিবিসি নিউজ বাংলা