
নিজের একটি আলাদা দর্শক শ্রেণী তৈরির পাশাপাশি বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে পরিবর্তনের হাওয়া দিয়ে চলেছেন নাট্য নির্মাতা ভিকি জাহেদ। যুগের চলমান সম্প্রচার মাধ্যম ওটিটি (ওভার-দ্য-টপ) প্ল্যাটফর্মেও ঘটে চলেছে তার সরব বিচরণ। সেই অবিস্মরণীয় কাজগুলোর সারিতে শামিল হওয়া আরও একটি কাজ ‘আমি কী তুমি’। গত ২৭ জুলাই চ্যানেল আইয়ের ওটিটি আই স্ক্রিনের পর্দায় দুপুর ৩টায় স্ট্রিমিং হয়ে গেলো ওয়েব সিরিজটির।নারীপ্রধান সিরিজটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন মেহজাবিন চৌধুরী। চলুন, সদ্য শুরু হওয়া এই ধারাবাহিকটির ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
আমি কী তুমি: বৈজ্ঞানিক পটভূমির রহস্য গল্প
একদিনে মুক্তিপ্রাপ্ত আট এপিসোডের সিজনকে খুব সংক্ষেপে বলা যেতে পারে রহস্য গল্প। প্রতিটি এপিসোডে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে রহস্যের জাল বুনে ধীরে ধীরে খোলা হয়েছে জটগুলোকে। তবে নিজের প্রথাগত থ্রিলার ও সাসপেন্স আবহের সঙ্গে ভিকি জাহেদ এবার যোগ করেছেন বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপট। তিথি নামের একটি মেয়ের জীবনের একটাই লক্ষ্য; আর তা হলো সিনেমার নায়িকা হওয়া। শহরে একের পর এক ঘটতে থাকা নারী হত্যা এবং সিনেমায় কাজ করার ব্যাপারে পরিবারের চাপ কোন কিছুই তার পথের কাঁটা হতে পারে না। কিন্তু একদিন রহস্যময় ক্রিস্টাল বৃষ্টির পর থেকে অদ্ভূত সব ঘটনা ঘটতে শুরু করে তিথির জীবনে। শুধু তাই নয়, পুরো জীবনের মানেটাই বদলে যায় তিথির কাছে। এমনি রহস্যে মোড়া জীবনচরিতের চারপাশ জুড়ে চিত্তাকর্ষক এক আবহের সৃষ্টি করা হয়েছে আকাশের গায়ে সবুজ বলয়রেখা দেখিয়ে। ট্রেলারের সময় থেকেই দৃশ্যটি দর্শকদের মনে একটাই সম্ভাবনার উদয় ঘটায়; আর তা হচ্ছে পৃথিবীতে এলিয়েন আগ্রাসন। কিন্তু তার সত্যতা এই প্রথম সিজনেই যাচাই করা হয়নি। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে দ্বিতীয় সিজনের জন্য। তবে প্যারালাল বা সমান্তরাল জগতের বিষয়টি এই প্রথমবারের মত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হলো বাংলাদেশি কোনও নাটকে। বাংলাদেশের প্যারালাল ভার্সন; বা সিগমা বাংলাদেশ শব্দ দুটো ইতোমধ্যেই ঠাই করে নিয়েছে দর্শকদের হৃদয়ে। ট্রেলার বা পোস্টার দর্শন পর্যন্ত ‘আমি কি তুমি’ শিরোনামটিকে ভাবা হয়েছিলো মনস্তাত্ত্বিক অথবা প্রতীকী হিসেবে। কিন্তু তা যে আসলে আক্ষরিক, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে সিরিজটি মুক্তির পর। কিন্তু এরপরেও টুইস্টে ভরপুর সিজনটি নতুন কিছু রহস্যের বীজ রেখে গেছে দর্শকদের জন্য। সেই সঙ্গে বাড়িয়ে দিয়ে গেছে দ্বিতীয় সিজন দেখার অদম্য আগ্রহ।
ভিকি জাহেদের নৈপুণ্যে নাট্যশাস্ত্রের অভিজাত ষোলকলা
রেডরাম, দ্যা সাইলেন্স ও পূনর্জন্ম-এর দর্শকরা ভিকি জাহেদের অনন্য গল্প বলার সঙ্গে অভ্যস্ত। সেই সঙ্গে বিদেশি গল্প ও সিনেমা অনুসরণের ব্যাপারটিও জড়িয়ে আছে তার নাটক নির্মাণের সঙ্গে। কিন্তু এই অনুসরণ তাকে নগ্ন অনুকরণের দিকে ঠেলে দেয়নি। বরং তাকে সাহায্য করেছে নাট্যশাস্ত্রের অভিজাত উপাদানগুলোকে আবিষ্কার করতে এবং তা রপ্ত করতে। আর তারই প্রভাব দেখা গেছে তার প্রতিটি কাজে। ২০১৬-এর সেই ‘মোমেন্ট্স’ শর্টফিল্ম থেকে শুরু করে এই ‘আমি কী তুমি’ ওয়েব সিরিজ পর্যন্ত গল্প দেখানোর ব্যাকরণগুলোর উত্তোরোত্তর আগমন ঘটেছে তার নির্মাণশৈলীতে। অধিকাংশ কাজে তার অনুসৃত পূর্বসূরীদের কিছুটা ঝলক থাকে। তবে এবার তিনি যেন উজাড় করে পরিবেশন করেছেন আলফ্রেড হিচকক, ডেভিড ফিঞ্চার ও মার্টিন স্করসেজের মত বিশ্বখ্যাত থ্রিলার নির্মাতাদের। তাছাড়া এর সম্পাদনা এবং ভিজুয়াল ইফেক্টের কাজও বাংলাদেশি নাটকে আগে কখনোই দেখা যায় নি। তিনি দারুণ ভাবে দেখিয়েছেন, কিভাবে কারিগরি বিভাগের অল্প পরিবেশনা দিয়েও বিশ্ব মানের কন্টেন্ট তৈরি করা যায়। নিজের কন্টেন্ট নির্মাণে যে তিনি কোনও রকম তাড়াহুড়ো করেন না, সে ব্যাপারে ভিকি ভক্তরা অবহিত আছেন। কিন্তু এবার আরও মজবুত ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তিনি বেশ পড়াশোনা করে তবেই মাঠে নামেন। সুতরাং দর্শক শুধু নির্মল বিনোদনই পাবেন না, তার নাটক দেখে অনেক চমকপ্রদ বিষয় সম্পর্কে জানবেনও। সেই অবাক করা তথ্যচিত্রের সাক্ষী হওয়ার জন্য হলেও দর্শকরা চোখ রাখতে চাইবেন এই নব্য নির্মাতার কাজে। এরকম বিস্ময়কর তথ্য সমৃদ্ধ কন্টেন্ট নির্মাণ করতে বাংলাদেশে এর আগে কেবল একজনকেই দেখা গেছে। তিনি হলেন প্রয়াত ঔপন্যাসিক ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ুন আহমেদ।
অভিনয়শৈলীতে সমৃদ্ধ ওয়েব সিরিজ ‘আমি কী তুমি’
যে মেয়েটিকে নিয়ে এই সিরিজটির গল্প তথা তিথির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মেহজাবিন চৌধুরী। গত কয়েক বছরে ভিন্ন চরিত্রে অল্প অল্প করে পরিশীলিত হওয়া মেহজাবিন আরও পরিণত হয়েছেন এবার। ‘বড় ছেলে’ ও ‘বুকের বাঁ পাশে’-এর সেই নায়িকা ‘চিরকাল আজ’, পূনর্জন্ম এবং ‘দ্যা সাইলেন্স’-এ এসে যেন আলবত বদলে গেছেন। তার সঙ্গে ছিলেন শ্যামল মাওলা, যিনি হইচই অরিজিনাল সিরিজ মানি হানি’র পর থেকে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন ওয়েব শিল্পী হিসেবে। চরকি অরিজিনাল ফিল্ম নেটওয়ার্কের বাইরে-খ্যাত জুনায়েদ বোকদাদি বেশ ভালোভাবে সঙ্গ দিয়েছেন মেহজাবিনকে। ঊনলৌকিক ও কারাগার সিরিজ-খ্যাত ইন্তেখাব দিনার এবং ৯০ দশকের স্বনামধন্য মডেল ও অভিনেত্রী সাদিয়া ইসলাম মৌ তাদের উপস্থিতি দিয়ে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। বর্তমান সময়ের ওয়েব দুনিয়ার সুপরিচিত বর্ষিয়ান অভিনেতা ও সঙ্গীত শিল্পী ফজলুর রহমান বাবু নিজের নামের সুবিচার করেছেন। জাগো বাহে সিরিজের বাঙ্কার বয় আবদুল্লাহ আল সেন্টুর জামশেদ চরিত্রটি পূনর্জন্মের কামালকে ছাড়াতে পারবে কিনা তার জন্য দ্বিতীয় সিজন অবধি অপেক্ষা করতে হবে। এছাড়া অন্যান্য চরিত্রে আরও ছিলেন ওয়াহিদা মল্লিক, তারিক আনাম খান, আনোয়ার শাহী ও রফিউল কাদের রুবেল। গল্প লেখনীতে পরিচালক ভিকি জাহেদের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন সোহাইল রহমান। পুরো সিজন নির্মাণে তার পুরনো টিমটাই অপরিবর্তিত ছিলো। সহকারি পরিচালনায় যৌথভাবে ছিলেন জুয়েল শেখ, মনির এইচ. বাবু ও তাহসিন বর্নো। প্রোডাকশন ডিজাইনের কাজ করেছেন আলভিরা তাসনিম। আর্ট ডিরেকশনে মো. রিঙ্কু এবং কস্টিউম ডিজাইনার হিসেবে ছিলেন জান্নাত মৌরি। ভিজুয়াল ইফেক্ট, আবহ সঙ্গীতের দায়িত্বে ছিলেন অর্নব হাসনাত। ২৩ জুলাইয়ে মুক্তি দেয়া হয় সিরিজটির একমাত্র ট্রেলার। এখানে শব্দ সংযোজনের কাজ করেছিলেন অর্নব। বিভিন্ন এপিসোডজুড়ে অপূর্ব সব ভিডিও ফুটেজগুলো সম্পন্ন হয়েছে সিনেমাটোগ্রাফার বিদ্রোহী দীপনের মাধ্যমে। সেখানে রঙ বিন্যাসের কৃতিত্বটা অবশ্য আশরাফুল আলমের।
১৪ জুলাই প্রকাশিত হয় প্রথম পোস্টার, যেখানে মেহজাবিনের মুখে পড়া ছিলো অস্কিজেন মাস্ক আর মাথায় ফুলের টায়রা। দুদিন বাদেই প্রকাশ করা হয় দ্বিতীয় পোস্টার, যেখানে শ্যামল মাওলা ও মেহজাবিন দেয়ালের দু’পাশ থেকে পরস্পরকে শোনার চেষ্টা করছিলেন। ১৮ জুলাই প্রকাশিত হয় সর্বশেষ পোস্টারটি। এখানে জুনায়েদ ও মেহজাবিনকে পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য অনেকগুলো হাত পেছন থেকে তাদের মাথা চেপে ধরে পেছন দিকে টানছে। প্রতিটা পোস্টার ডিজাইন করেছেন সাজ্জাদুল ইসলাম সায়েম এবং স্টিল ফটোগ্রাফিতে ছিলেন অঙ্কুর রয়। সিরিজের সার্বিক সম্পাদনার কাজ সমাধা করেছেন জুবায়ের আবির পিয়াল। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের প্রযোজনায় আই স্ক্রিন অরিজিনাল সিরিজটি নির্মাণ হয় কেএস ফিল্ম্স প্রোডাকশন হাউজে। পরিবেশনায় ছিলো ওয়াল্টন স্মার্ট ফ্রিজ ও দারাজ। রেডিও পার্টনার হিসেবে রেডিও ভূমি এবং প্রিন্ট মিডিয়া পার্টনার হিসেবে কাজ করেছে আনন্দ আলো। গুগলের বিনোদন বিভাগের শীর্ষ দশ প্লাটফর্মের মধ্যে এখন সপ্তম অবস্থানে রয়েছে আইস্ক্রিন। এর পুরো কৃতিত্বটাই ‘আমি কী তুমি’ ওয়েব সিরিজের। এই শুরুতেই প্রথম সিজনের অসামান্য জনপ্রিয়তা দাবি রেখে যাচ্ছে ‘আমি কী তুমি’-এর দ্বিতীয় সিজনের। এই দাবি যে শুধু ভক্ত বা বিস্মিত হওয়া নতুন দর্শকদের তা নয়! বাংলাদেশের নাটক ও সিনেমা শিল্পে এখনও গোপন থাকা শত শত প্রতিভাধর নির্মাতাদের জন্য এটি এক অকৃত্রিম হাতছানি। সেই সম্ভাব্য মঞ্চে হয়ত চমকপ্রদ আগমন ঘটবে নতুন কোনও মেহজাবিনের। অথবা নতুন মহিমায় আবির্ভূত হবেন দীর্ঘদিন ধরে আপন দ্যুতি হারানো কোনও বর্ষিয়ান অভিনয়শিল্পী।